ভারত সীমানা ঘেঁষা অপরূপ পানছড়ি উপজেলা

শাহজাহান কবির সাজু:

বনজ সম্পদে ভরপুর সীমান্ত ঘেঁষা খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত উপজেলার নাম পানছড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক এবং দেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবহুল পানছড়ি উপজেলা। এই পানছড়ি থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলছিল গেরিলা যুদ্ধ। আবার এই এলাকাতেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। যার ফলে অবসান ঘটে গেরিলা জীবনের, শান্তি আসে পার্বত্য জনপদে। তাই দেশ-বিদেশে ‘শুরু এবং শেষের’ উপজেলা হিসেবে পানছড়ি ব্যাপক পরিচিত লাভ করে।

নামকরণ

এককালে পানছড়িতে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি পান উৎপাদন হতো। এলাকাবাসীর চাহিদা মিটিয়ে এই পান নদী পথে রপ্তানি করা হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে পানছড়ির কৃষকরা পান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতো বলে এই এলাকার নাম দেওয়া হয় পানছড়ি। বর্তমানে পানচাষিদের অনাগ্রহের কারণে পানের ঐতিহ্য বিলীন হতে চলেছে।

অবস্থান

পানছড়ির উত্তরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং, পূর্বে দীঘিনালা, দক্ষিণে খাগড়াছড়ির সদর। ৩৩৪.১১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে ৫টি ইউনিয়নের ৭টি মৌজার অন্তর্গত ২২০টি গ্রাম নিয়ে পানছড়ি। আর এই পানছড়ি উপজেলার বুক চিরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে গেছে চেঙ্গী নদী। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে এসে পানছড়ির বুক চিরে খাগড়াছড়ি শহর অতিক্রম করে পতিত হয়েছে সাম্পান মাঝির কর্ণফুলী নদীতে।

উৎপাদিত ফসল ও জমির পরিমাণ

উপজেলায় ১৪টি ব্ল¬কে মোট জমির পরিমাণ ৩৩৪২৫ হেক্টর, তার মধ্যে আবাদি জমি ৮৯৬০ হেক্টর (১ম শ্রেণি)। এক ফসলী জমি ৩৪৯৫ হেক্টর, দু-ফসলী জমি ২২৩৫ হেক্টর, তিন ফসলী জমি ৩৫৫ হেক্টর। অপরদিকে ২য় শ্রেণি অনাবাদি জমি ৪৫২ হেক্টর, স্থায়ী পতিত জমির পরিমাণ ৪৫২ হেক্টর, উঁচু জমি ৪৩৯০ হেক্টর, উঁচুনিচু জমি ৪২৫৩৫ হেক্টর, বনভূমি ২১২৬৫ হেক্টর যা পাহাড় এবং টিলা। এই টিলা-পাহাড়ে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বনজ সম্পদ। এখানে প্রতি বছর খাদ্যের চাহিদা ৯১৮৮ মেট্রিক টন, উৎপাদিত হয় ১৭১১৬ মেট্রিক টন, উদ্বৃত্ত ৭৯১৪ মেট্রিক টন। অপরদিকে মাছের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ১১৩৫.১১ মেট্রিক টন, এই উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রার বিপরীতে ৪৪০.২৩ হেক্টর জমিতে পুকুর ও জলাশয় রয়েছে ৭৮১টি, যা থেকে প্রতি বছর মাছ উৎপাদন হয় ৮০১.২৭৫ মেট্রিক টন। ঘাটতি রয়েছে ৩৩৩.৮৩৫ মেট্রিক টন। যার কারণে এই এলাকায় পুষ্টিহীনতায় ভোগে জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ।

জনসংখ্যা

উপজেলায় ইউনিয়ন রয়েছে ৫টি; ১নং লোগাং, ২নং চেংগী, ৩নং পানছড়ি, ৪নং লতিবান ও ৫নং উল্টাছড়ি। লোগাং ইউপির মোট জনসংখ্যা ১১৬৩৪ জন। যার মাঝে পুরুষ ৫৮৩৭ ও মহিলা ৫৭৯৭। চেংগীর সর্বমোট জনসংখ্যা ৮০২৯ জন। এর মাঝে পুরুষ ৪০৩৭ ও মহিলা ৩৯৪২ জন। ৩নং সদর পানছড়ি ইউপির সর্বমোট জনসংখ্যা ২২৭০৬ জন। এর মাঝে পুরুষ ১১৫২৭ ও মহিলা ১১১৭৯ জন। ৪নং লতিবানের মোট জনসংখ্যা ৮০২৯ জন। যার মাঝে পুরুষ ৪২৪১ জন ও মহিলা রয়েছে ৪০৪৯ জন। উল্টাছড়ির সর্বমোট জনসংখ্যা ১১৪৮০ জন। যার মাঝে পুরুষ ৫৭১০ ও মহিলা ৫৭৭০ জন। ৩১,৩৫২ জন পুরুষ ও ৩০,৮৪৬ জন মহিলা নিয়ে উপজেলার সর্বমোট জনসংখ্যা ৬২,১৯৮ জন। মোট ভোটারের সংখ্যা ৩৯,৭২০। এর মধ্যে পুরুষ ২০,৩২০ এবং মহিলা ভোটারের সংখ্যা ১৯,৪০৩ জন।

প্রতিষ্ঠান

এই উপজেলায় রয়েছে দুটি কলেজ, একটি আলিম মাদ্রাসা, একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা, ৭টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি হাসপাতাল। উপজেলায় শিক্ষার হার ৪২.৩০%।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান

উপজেলায় মসজিদ রয়েছে ৩১টি, বৌদ্ধ মন্দির ৭৬টি, হিন্দু মন্দির ৬৪টি ও গীর্জা রয়েছে ৫টি। পাকা রাস্তা রয়েছে ২০ কিলোমিটার, ব্রিক সলিং রয়েছে ৫৫ কিলোমিটার, কাঁচা রাস্তা রয়েছে ২০৮ কিলোমিটার।

দর্শনীয় স্থান

পানছড়ি সদর উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শান্তিপুর অরণ্য কুটির। এই কুটিরে প্রবেশ মুহুর্তে চোখে পড়ে নয়নাভিরাম ৪৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্টবৌদ্ধ মূর্তি। যা এক সময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ। এই মূর্তি দেখার জন্য বেড়াতে আসে শত শত পর্যটক। শান্তিপুর থেকে অরণ্য কুটিরের প্রবেশ পথেই আছে রাবার ড্যাম। শীত মৌসুমে ড্যামের ঝর্ণার কলকল পানির শব্দ চারিদিক মুখরিত করে রাখে। পানছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে মন মাতানো, চোখ জুড়ানো পর্যটন স্পর্ট ঝর্ণা টিলা। সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অক্লান্ত পরিশ্রমে উপজেলার কং-চাইরী পাড়ায় গড়ে উঠেছে মিনি পর্যটন কেন্দ্র। বিশ একর জায়গা জুড়ে চারিদিকে মৎস্য খামার আর সবুজে ঘেরা বেষ্টনির মাঝে বয়ে চলা লেকের মোহনীয় ঢেউ যেন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। লেকটিকে আধুনিক রূপে সাজিয়ে তুলতে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ হাতে নিয়েছে নানান উদ্যোগ। যা কিছুদিনের মধ্যেই জেলার অপরূপ সৌন্দর্যের তালিকায় প্রথম কাতারে স্থান করে নেবে।

চিকিৎসা

চিকিৎসা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার দিক দিয়ে এই পানছড়ি দেশের প্রথম স্থান অধিকার করে বরাবরই। নামে মাত্র চলে চিকিৎসা সেবা। প্রায়ই ডাক্তারশূন্য থাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্স। দীর্ঘদিন যাবৎ ৬২ হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা চলছে ঢিলে-ঢালাভাবে। মাঝে মধ্যে ভালো ডাক্তার এলেও কর্তব্যস্থলে যোগ দেওয়ার আগেই বদলীর আদেশ নিয়ে পাড়ি জমান অন্যত্র। তাছাড়া কোটি টাকা মূল্যের এক্সরে মেশিন ও অপারেশন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ১নং লোগাং ইউপিতে একটি মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও ছিল না কোন সেবার চিহ্ন। দায়িত্বরতরা মন চাইলে খুলতেন। তবে এর রূপ পালটে দিয়েছে বে-সরকারি এনজিও সংস্থা ইপসা। ইপসা কেন্দ্রটিকে সাজিয়েছে নান্দনিক সাজে। যার ফলে প্রত্যন্ত এলাকাবাসীর মাঝে ফিরেছে স্বস্তির নিঃস্বাস।

সমস্যা ও সম্ভাবনা

আঞ্চলিক সংগঠনের ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষে শান্তির এই জনপদে অশান্তি, সরকার দলীয় গ্রুপিং ও বিভিন্ন সংগঠনের চাঁদাবাজি হলো এই উপজেলার মূল সমস্যা। তাছাড়া উপজেলা থেকে বিভিন্ন গ্রামীণ জনপদে বয়ে চলা রাস্তাগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই কষ্টকর। এই উপজেলায় ভালো মানের কোন আবাসিক হোটেল ও রেঁস্তোরা নেই। পানছড়ি বাজারে শুকতারা বোডিং নামে একটি আবাসিক হোটেল থাকলেও মানসস্পন্ন নয়। তবে এই এলাকায় উৎপাদিত আম, রসালো লিচু, কাঁঠাল, আনারস, মালটা, জাম্বুরা, আমলকি, পেঁপে খুবই সুস্বাদু; যা এলাকার চাহিদা পূরণ করে সমতলেও রপ্তানি হয়। তাছাড়া শীত মৌসুমে এই এলাকার সবজি মাঠের প্রাণবন্ত দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। এই এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তাহলে এলাকায় বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।

খেলাধুলা

খেলাধুলার ক্ষেত্রে জেলা পর্যায় ছাড়াও বিভাগীয় পর্যায়েও পানছড়ির ভালো সুনাম রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়েও সুনাম অর্জন করেছে। তাছাড়া আন্তঃ স্কুল ফুটবলে পানছড়ির পূজগাং মূখ উচ্চ বিদ্যালয় জেলা চ্যম্পিয়ন হয়ে পানছড়ির জন্য বিশাল গৌরব বয়ে আনে। জেলা ভলিবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব এই পানছড়ির। তাছাড়া পানছড়ি ফুটবল একাডেমির ক্ষুদে ফুটবলাররা বিভাগীয় পর্যায়েও সাফল্য দেখিয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

খাগড়াছড়ির সাথে পানছড়ির সংযোগ সড়কের ২৫ কিলোমিটার রাস্তায় বর্তমানে চলছে সংস্কারের কাজ। বিশেষ করে ১৬টি ব্রিজের কাজ চলছে একসাথে। একাজ শেষ হলেই যোগাযোগ ব্যবস্থার মান উন্নত হবে।

উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী অফিসার যা বললেন

পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের যৌথ উদ্যেগে এগিয়ে যাচ্ছে পানছড়ি। ইতোমধ্যে কং চাইরী পাড়ার ‘মায়াবীনি’ শান্তিপুরের রাবার ড্যাম ও অরণ্য কুটির দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। সবুজের সমারোহে ঘেরা অপরূপ সুন্দরের পানছড়িকে নান্দনিক সাজে সাজানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে বলেও তারা নিশ্চিৎ করেন।

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ১

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন