parbattanews

বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন?

মেহেদী হাসান পলাশ

আজ ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস। ১৯৮২ সালের এই দিনে ফ্রান্সের জেনেভা শহরে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে ৯ আগস্টকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসাবে নির্ধারণ করা হয় এবং ১৯৯৪ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সম্মেলনে এ দিবসকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস রূপে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে সারা বিশ্ব প্রতিবছর বিশ্বে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করে আসছে। বর্তমান বিশ্বে ৩৭ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস- যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগ। বিশ্বের ৯০ টি দেশে এই ৩৭ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। তারা বিশ্বের ৭ হাজার ভাষা ও ৫ হাজার স্বতন্ত্র সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। প্রত্যেক বছর বিশ্ব আদিবাসী দিবসের একটি থিম থাকে। এ বছর বিশ্ব আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- “Indigenous peoples’ migration and movement.” বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর বাংলা করেছে, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দেশান্তর ও প্রতিরোধের সংগ্রাম’।বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বিশ্বের এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অগ্রীম শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাই।

২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা বাংলাদেশে নিজেদের আদিবাসী দাবী করে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন শুরু করে।  পরবর্তীকালে তারা দেশের সমতলের বিভিন্ন উপজাতীয় ও তফসিলী জনগোষ্ঠীকেও এতে সামিল করে মোট ৪৫ টি মতান্তরে ৭৫ টি জনগোষ্ঠীকে একত্রে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের স্বীকৃতি দাবী করে। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এই আদিবাসী দাবী শুরুতেই দেশের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। কারণ আভিধানিক ও নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। আদিবাসী শব্দের ইংলিশ প্রতিশব্দ Indigenous people. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, “কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।” মর্গান বলেন, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial … they are the true Sons of the soil…”. (Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972).

সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই বর্হিবিশ্ব বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন সময়। এই অনুপ্রবেশও স্মরণাতীত কাল পূর্বে ঘটে নাই। মাত্র ৫-৭ শত বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারেও আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃত নয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় মানব বসতির যেসব প্রত্নবস্তু, অবস্থান ও প্রমাণ পাওয়া গেছে তা খৃষ্টপূর্ব ১৬০০-৫০০ সালের পুরাতন। সেকারণে উপজাতিদের আদিবাসী আখ্যাদানকারী গবেষকগণ এখন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কনভেনশন-১৬৯’র আদিবাসী বিষয়ক সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা করে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও তফশিলী সম্প্রদায়কে আদিবাসী দাবি করছেন ও দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করছেন।

এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত: তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো: ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত-  Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107),  আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত- Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169),  এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে  The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples.

এখানে আইএলও’র প্রথম চার্টার দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চার্টার দুটির শিরোনাম হচ্ছে- Indigenous and Tribal Populations Convention. অর্থাৎ আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন। অর্থাৎ এই কনভেনশনটি আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কনভেনশনে পাস হওয়া ধারাগুলো একই সাথে আদিবাসী ও উপজাতি নির্ধারণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। শুধু আদিবাসীদের নয়। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে আদিবাসীদের জন্য এক্সক্লুসিভ করে উপস্থাপন করা হয়।

এখানে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)-  এর আর্টিকল ১ এর (a)তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations’. অর্থাৎ  একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিসসমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিস্কার বোঝা যায় তারা উপজাতি। কেননা, ট্রাইব শব্দের বাংলা অর্থ উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের মতলববাজ বুদ্ধিজীবীরা আইএলও কনভেনশনের আর্টিকল ১-এ উপস্থাপিত ট্রাইবাল ডেফিনেশনটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাস পিপলের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করে থাকেন।

এখন আমরা ইনডিজিন্যাস পিপলের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করবো।  Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- এর আর্টিকল ১-এর (b)তে ইনডিডজিন্যাস পিপল বা আদিবাসীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions’.

অর্থাৎ আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া বা বর্তমান সীমানা নির্ধারণের পূর্বে বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে। এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে।

আইএলও কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার, বর্তমান সীমানা নির্ধারণের পূর্বে বা উপনিবেশ সৃষ্টি পূর্ব থেকে বসবাস। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি উপজাতিদের মতোই। অর্থাৎ একজন উপজাতি আদিবাসী হবেন বা হবেন না উপরোক্ত শর্তের ভিত্তিতে।

এছাড়াও রয়েছে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples চার্টার। এটি এক্সক্লুসিভলি আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, উপজাতিদের নয়।

Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)-  ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেশন র‌্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশ এই কনভেনশন র‌্যাটিফাই করেছে। বাংলাদেশ এই কনভেনশন র‌্যাটিফাই করলেও তা ছিল বৈশ্বিক দৃষ্টিতে। কেননা, বাংলাদেশ কখনই এ দেশে কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তা স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের বাইরে উপমহাদেশের পাকিস্তান ও ভারত এই কনভেনশন র‌্যাটিফাই করেছে। যদিও এরই মধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে  Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- ১৯৮৯ পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের  মাত্র ২৩টি দেশ এই কনভেনশন র‌্যাটিফাই করেছে। এরমধ্যে কনভেনশন-১০৭ থেকে বেরিয়ে আসা ৮টি দেশও রয়েছে। উপমাহদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশন র‌্যাটিফাই করেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো উপমহাদেশীয় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানও Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)- র‌্যাটিফাই করলেও কনভেনশন-১৬৯ র‌্যাটিফাই করেনি। কনভেনশন- ১৬৯ অবশ্য ১০৭-এর মডিফিকেশন, তবুও তা আলাদা করে র‌্যাটিফিকেশন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, কনভেনশন-১৬৯ পাস হওয়ার পর কনভেনশন-১০৭ এর গুরুত্ব হারিয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক চার্টার কোনো দেশ র‌্যাটিফাই না করলে তা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আইএলও কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯ যে দেশগুলো র‌্যাটিফাই করেছে তাদের বেশিরভাগই আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশ যাদের প্রধান বা অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত।

অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এ ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করলে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন ১০৭, ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারের সিগনেটরি বা ভোটদানকারী নয়। এ থেকেই নিজ দেশের আদিবাসীদের জন্য তাদের নিজেদের অবস্থান এবং অন্যদেশের ‘আদিবাসীদের’ জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণের কারণ ও মতলব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। উল্লিখিত চারটি দেশ শুধু ইউএন চার্টারের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তাই নয় বরং অধিবেশনে তাদের প্রতিনিধিরা এই চার্টারের প্রবল সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছে।

এখন বিবেচনা করা যাক, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ড অধিকৃত হওয়ার পূর্ব থেকে বা প্রি-কলোনিয়াল কি-না? তবে এ আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় নির্ধারণ করা জরুরি যে, বিবেচনাটি কি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপর হবে, না বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক হবে। কারণ অঞ্চলভিত্তিক হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যিনি প্রথম বসতিস্থাপন করেছেন তিনিও বাংলাদেশের আদিবাসী। এবং আগামীতে যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নতুন কোনো দ্বীপ সৃষ্টি হয় আর সেই দ্বীপে যারা বা যিনি নতুন বসতি গড়বেন তিনিও আদিবাসী হবেন। বর্তমান সরকার নতুন সৃষ্ট ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে, সেটা যদি সফল হয় তাহলে রোহিঙ্গাদেরও কি বাংলাদেশের আদিবাসী বলা হবে? সাংস্কৃতিকভাবে রোহিঙ্গারাও তো বৈশিষ্টমণ্ডিত। একইভাবে ঢাকার আদি বাসিন্দা যারা তারাও বাংলাদেশের আদিবাসী এবং যেসকল উপজাতি ঢাকায় নানাভাবে স্যাটেল করেছেন তারা স্যাটেলার? কারণ এই সংজ্ঞার উপাদানগুলো ইংলিশ OR  শব্দদ্বারা বা অথবা শব্দ দ্বারা বিভক্ত।

আর যদি সমগ্র বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধরা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্যজাতি। আর্যরা উত্তর বঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। তখন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চাকমা, মারমা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারো অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ আর্যদের আগমনের পূর্বে এখানে যে অনার্য জনগোষ্ঠী বসবাস করতো তারা প্রি-কলোনিয়াল। আর্যদের আগমণের পূর্বে এখানকার অনার্য বাসিন্দারা প্রাকৃত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। আর্যদের প্রভাবে তারা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে হিন্দু রাজাদের নিকট থেকে বাংলা বৌদ্ধ রাজাদের দখলে যায়। বাংলাদেশে বৌদ্ধদের ইতিহাস সমৃদ্ধির ও গৌরবের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের আদি কিতাব চর্যাপদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। পাল রাজারা বাঙালি ছিলেন, যেমন ছিলেন মহামতি অতীশ দীপঙ্কর। বাংলায় বৌদ্ধদের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস এক নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রি কলোনিয়াল জনগোষ্ঠী হচ্ছে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এখানকার মূল জনস্রোত, বাঙালি জনগোষ্ঠী।

সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেক বিদগ্ধজনের মুখে শোনা যায়, উপজাতি বললে তারা যদি অপমানিত বোধ করে, হেয় বোধ করে এবং আদিবাসী বললে যদি খুশী হয় তাহলে তা বলতে দোষ কোথায়? ইতিহাসে যাই-ই থাক, শতকরা ৯৮ ভাগ একক বাঙালি জনগোষ্ঠীর দেশে আমরা আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি এইটুকু উদারতা কি দেখাতে পারি না? এই প্রশ্ন যেকোনো সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের হৃদয় বিগলিত করতে বাধ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য ভাইস চ্যান্সেলরও একবার একান্ত আলোচনায় আমার কাছে এই মত প্রকাশ করেছিলেন। প্রশ্নটি অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। আগেই বলা হয়েছে, এ ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করলে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘোষণাপত্রে সর্বমোট ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এসব অনুচ্ছেদের বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, সংবিধান ও আত্মপরিচয়ের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, যেসব ব্যক্তিবর্গ খুব সরলভাবে বা অসেচতন-উদারতায় উপজাতিদের আদিবাসী বলতে ইচ্ছুক/আগ্রহী তাদের অনেকেই হয়তো এই ঘোষণাপত্র পড়ে দেখেননি অথবা তার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন (অবশ্য তারা মতলববাজদের কথা আলাদা)। নিম্নে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের কিছু অনুচ্ছেদ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

অনুচ্ছেদ-৩ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।

অনুচ্ছেদ-৪ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৫ : আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।অনুচ্ছেদ-৬ : আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।

অনুচ্ছেদ-১৯ : রাষ্ট্র  আদিবাসীদের প্রভাবিত করতে পারে এমন আইন প্রণয়ন কিংবা প্রশাসনিক সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পূর্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি নেয়ার জন্য তাদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আন্তরিকত্ব সদিচ্ছার সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।

উপরের অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে। এবং এসব অঞ্চলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হবে। লক্ষণীয়, প্রকাশ্যে বলা না হলেও এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার মধ্যে লুকানো রয়েছে স্বাধীনতার বীজ।

এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির উপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক। যেমন :

অনুচ্ছেদ-১০ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি কিংবা ভূখণ্ড থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বাধীন ও পূর্ববহিত সম্মতি ছাড়া কোনভাবে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা যাবে না এবং ন্যায্য ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সমঝোতা সাপেক্ষে স্থানান্তর করা হলেও, যদি কোন সুযোগ থাকে, পুনরায় তাদেরকে সাবেক এলাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

অনুচ্ছেদ-২৬ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।

২৬: ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।

অনুচ্ছেদ-২৭ :  রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমি মালিকানাধীন ব্যবস্থাপনার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করবে।

অনুচ্ছেদ-২৮ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।

২৮: ২. সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় অন্য কোন কিছু রাজি না হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গুণগত, পরিমাণগত ও আইনি মর্যাদার দিক দিয়ে সমান ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ অথবা সমান আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বা অন্য কোন যথাযথ প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অনুচ্ছেদ-৩০ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখ-ে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না।

অনুচ্ছেদ-৩২ : ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোন প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, জল কিংবা অন্য কোন সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানা (আদিবাসী নয়) রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে বা তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি উপজাতীয়রা রাজি না হলে সমতল থেকে সমপরিমাণ সমগুরুত্বের ভূমি ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ঐ গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সেকারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ইউএনডিপিসহ কিছু বৈদেশিক সংস্থা ইতোমেধ্যে প্রকাশ্যে এ দাবি তুলেছে।

ঘোষণাপত্রের ৩৬ অনুচ্ছেদটি আরো ভয়ানক।

অনুচ্ছেদ-৩৬ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর, বিশেষত্ব যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে তারা অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠী তথা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ যোগাযোগ, সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।

আমরা জানি বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল আবাস ভারত ও মিয়ানমার। সেখানে এখনো তাদের মূল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে তাদের খণ্ডিত অংশ যদি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে ভারতের সমগ্র সেভেন স্টিস্টার্স রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের বিপুল এলাকা আদিবাসী ল্যান্ড স্বীকৃতি পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। একই সাথে সীমান্তের উভয়পাড়ের অভিন্ন জনগোষ্ঠী যদি অভিন্ন রাজনৈতিক, সরকার কাঠামো কিংবা স্বাধীনতার দাবি তোলে তা আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নেবে। এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী ভারত সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে পারে।  আদিবাসী জনগোষ্ঠী উল্লিখিত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে যা ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান স্বাধীন করণে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্বের দেশপ্রেমিক জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। অধুনা পশ্চিম পাপুয়া নিউগিনিতেও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

যদিও ৪৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন আদিবাসীর দাবি এমন একটা জনগোষ্ঠী থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যারা ৪২ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কৌশলগত কারণে তারা স্বায়ত্তশাসনের কথা যতোটা উচ্চকিত করে স্বাধীনতার কথা ততোটা নয়। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষই রাষ্ট্রবিরোধী এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও রহস্যময় আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছে দেশবিরোধী এই দুষ্টুক্ষত। কিন্তু যারা সচেতন, বিশেষ করে যারা সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করেন তাদের প্রতি আহ্বান একবারের জন্য হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের পরিচালিত প্রোফাইল, গ্রুপ ও পেইজগুলো ভিজিট করে দেখুন কী ভয়ানক রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেখানে। স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড গঠনের জন্য নিজস্ব জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মানচিত্র দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা সচেতনতার জন্য দেশবাসীর জানা উচিত।

পাঠকের জ্ঞাতার্থে সিএইচটি জুম্মল্যান্ড নামে তাদের পরিচালিত একটি পেইজের ঠিকানা এখানে দেয়া হলো :(https://www.facebook.com/pages/CHT-jummaland/327524104096965?fref=ts)।

শুধু ফেসবুক বা সামাজিক গণমাধ্যম নয়, পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীরা নিউজ পোর্টাল খুলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের প্রচার চালাচ্ছে। তাদের পরিচালিত অসংখ্য সাইটের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, chtnews.com. এই সাইটে করুণালঙ্কার ভান্তে নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রচার হচ্ছে বেশ কয়েকদিন ধরে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশধারী এই ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় তার কর্মতৎপরতার কথা বিস্তারিতভাবে বলেছেন। অডিও-ভিডিও’র এই স্বাক্ষাৎকারে ভান্তে আরো জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে। এখন তিনি শুধু ৫ লক্ষ গোলাবারুদ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এই পরিমাণ গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ভিক্ষু সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের উদাহরণ তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী তরুণ প্রজন্মকে তার সাথে একাত্ম হতে অহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আন্তর্জাতিক শক্তিকে তিনি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাবেন বলেও জানিয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশের উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকৃতি কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয়। এর সাথে জড়িত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, ইতিহাস ও মর্যাদার প্রশ্ন।

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, আগস্ট, ২০১৮ সংখ্যা।

মেহেদী হাসান পলাশ: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ ও সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব।

email: palash74@gmail.com  


পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা

Exit mobile version