প্রচুর মিথ্যাচার ও বাহুল্য প্রচারণা চলছে পাহাড় ঘিরে
ইমরান চৌধুরী
গুগল হচ্ছে অধুনা তথ্যভাণ্ডার। এখানে কোন বিষয়ে বহুমাত্রিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক খোঁজে গুগলকে একপেশে তথ্য তুলে আনতে দেখা যায়। দোষটা গুগলের নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিদেশী প্ররোচনায় এতো সংঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত প্রচারণা চলছে যে, তার ঠ্যালায় পাহাড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সামনে খেলো করে উপস্থাপন করা সম্পন্ন হয়েছে।
আর এসবের প্রতিক্রিয়ায় সমতলের বাসিন্দারা হয়ে পড়েছে বিভ্রান্ত। এদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির সুযোগে ‘সেটেলার’, ‘আদিবাসী’ শব্দগুলো এদেরকে দিয়েই সার্বজনীন করা হচ্ছে। আজ আমার মতো কতিপয় মানুষ আছে। আমরা না থাকলে, একপেশে রটনা ও ক্ষেত্রবিশেষে ডাহা মিথ্যাচারগুলো সত্যিতে পরিণত হয়ে গোয়েবলসের বিদেহী আত্মায় পুষ্পস্তবক নিক্ষেপ করবে!
প্রচুর মিথ্যাচার, বাহুল্য প্রচারণা চলছে পাহাড় ঘিরে। এসব প্রচারণাগুলো ন্যূনতম দরকষাকষিহীন। ‘অ্যাট্রোসিটি’ বা গণহত্যার নিচে তো কিছুই নেই! অথচ পাহাড়ে সেনাবাহিনী বা বাঙ্গালীদের তরফে কোন গণহত্যা হয়নি। যদি হতো, তাহলে কয়েক লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর মানুষ রোহিঙ্গাদের পরিণতি বরণ করতো। সেনাবাহিনী সর্বদা কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে চেয়েছে।
যেমন, আশির দশকের শেষে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল আবদুস সালামের পরিকল্পনা ছিল পাহাড়ে পরিকল্পিত গুচ্ছগ্রাম সৃজনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে স্তিমিত করা। আবার জেনারেল গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান সম্ভবত গুইমারায় ব্রিগেড কমান্ডার থাকার সময় চেষ্টা করেছিলেন চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিপক্ষে একটি সশস্ত্র কুকি বা লুসাই বাহিনী গঠনের।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ লাভ করেনি, করেছে কৌশল আর চাণক্য বিদ্যা প্রয়োগ করে। এটাই কাউন্টার ইন্সারজেন্সি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রক্তের বিনিময়ে টিকে থাকতে হয়েছে বাঙ্গালীদের। ক্রোধ, ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার সাথে খেয়াল করেছি, সমতলের তরুণদের মনে এমন ধারণা গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, পাহাড়ে চাকমারাই মার খেয়েছে। অথচ উল্টোটাই সত্যি।
১৯৮৪ সালের ৩১ মে এক ভূষণছড়ার হত্যাযজ্ঞেই অতর্কিত আক্রমণে এক রাতে ৩৮৪ জনকে হত্যা করা হয়, যাদের সবাই ছিল বাঙ্গালী। হ্যাঁ, সংখ্যাতত্ত্ব অথবা হামলার ধরণের দিক থেকে একে অ্যাট্রোসিটি বা গণহত্যা বলা চলে, আঞ্চলিক ফিউড বা দাঙ্গায় ঘটা বিচ্ছিন্ন প্রাণহানিকে নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী প্রথম প্রবেশ করে ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে। সম্ভবত, ১৯৭৬ সালে বিনা উসকানিতে এক সামরিক কনভয়ের উপর অ্যামবুশে প্রায় পুরো কনভয়কে শেষ করে দেয়া হয়েছিলো। এই কথা কি গুগলে আসে? ৯২ বা ৯৫ জন সৈন্য সেই অ্যামবুশে শহীদ হয়েছিলো। তাঁদের আমরা ভুলে গেছি কোন দোষে? এই বিপুল প্রাণহানির প্রধান প্রতিক্রিয়া ছিল চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশন স্থাপন করা। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনী কয়টা পাহাড়ি গ্রাম ধ্বংস করেছিলো, বা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো?
দোষটা আমাদের। আমাদের কলা দেখিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রোপাগান্ডা মেশিন খাড়া করানো হয়েছে। বাংলাদেশ এর পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যার কারণে বিনা বাঁধায় পাহাড়িদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে, কিন্তু সেনানিবাস এলাকায় একটি পাঞ্জেগানা মসজিদ স্থাপন করতে গেলেও প্রতিক্রিয়া আসে লন্ডন থেকে!
এখনো কি আমাদের হুঁশ ঠিকানায় আসার সময় হয়নি? সাবধান হবার মতো সময় কি আর আছে? আমরা কি এখনো ‘আদিবাসী’, ‘সেটেলার’ প্রসঙ্গের বুনিয়াদী বিভ্রান্তিতেই ভ্রান্তিবিলাস করে যেতে থাকবো?
ইমরান চৌধুরী: জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট