পাহাড়ে পর্যটন বিকাশে উপজাতি সন্ত্রাসীদের বাধা : হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার

সাজেক১

মিয়া হোসেন, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে:
উচু-নীচু পাহাড়, পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত ঝর্ণা, নয়নাভিরাম সবুজ গাছপালা, হাত বাড়ালেই যেন ছোয়া যায় মেঘ, আকাশের বিশালতা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। এ সবই রয়েছে আমাদের মাতৃভূমির তিন পাবর্ত্য জেলায়। একটু ছুটি পেলেই পর্যটকরা ছুটে যায় পাহাড়ী এলাকায় ঘুরতে। কিন্তু এ এলাকায় পর্যটন বিকাশে পদে পদে বাধা দিচ্ছে উপ-জাতি সন্ত্রাসীরা। এমন কী পর্যটকদের আগমন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছে, আর চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পার্বত্য এলাকায় পর্যটন বিকশিত করতে পারলে প্রতি বছর সরকার ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলার দার্জিলিং খ্যাত সাজেক পর্যটন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের ভিড়। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে এখানে থাকার জন্য কক্ষ পাওয়া যায় না। আগে থেকেই বুকিং হয়ে যায়। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সরেজমিন রিপোর্ট

স্থানীয় সাজেক এলাকার বাসিন্দারা জানান, আমরা এই পর্যটন কেন্দ্রের কারনে অনেক উপকৃত হচ্ছি। আমরা পাহাড় পুড়িয়ে জুম চাষ করতাম। কিন্তু এখন এই পর্যটন কেন্দ্রে আয় দিয়েই গোটা বছর চলে যায়। কষ্ট করে জুম চাষ করতে হয় না। কিন্তু কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসীরা নানাভাবে এই পর্যটন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।

গত কয়েক মাস আগে ‘বৃহত্তর সাজেক ইউনিয়নবাসী’ ব্যানারে পর্যটনের বিরুদ্ধে একটি লিফলেট প্রচার করেছে সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ে মানুষের সমাগম বাড়লে সন্ত্রাসীরা আতঙ্কিত হয়ে যায়, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে তারা ভয় পায়। এ জন্য পর্যটনের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছে।

সাজেকের স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, সাজেক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই দুই পাড়ার দারিদ্র জনগনের ব্যাপক আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। এখন আমরা স্ত্রী পরিবার নিয়ে খেয়ে পরে সুখে বাস করতে পারছি।

সাজেক পর্যটনকে কেন্দ্র করে ৩৫জন দারিদ্র ত্রিপুরা ও মিজো, পাংখু ব্যক্তিবর্গের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই সাথে স্থানীয় ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট বড় ৩০-৩৫টি রিসোর্ট, হোস্টেল গড়ে উঠেছে, যার দ্বারা আরো অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন হয়েছে। আমরা এলাকাবাসী আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর।

তারা আরো বলেন, পর্যটনের জন্য আমাদের কোন পরিবার ও ব্যক্তিকে উচ্ছেদ হতে হয়নি বরং হেডম্যানের সহায়তায় নতুন স্থানে পরিকল্পিত ও আধুনিক বাসস্থান তৈরী করে দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের উপকৃত করেছে।

সাজেক পর্যটন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনিত্য ত্রিপুরা বলেন, আমাদের সমিতির সদস্য ১৬জন। তবে এখানে ৩৫-৩৬টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এতে ৩-৪ হাজার মানুষ একত্রে বাস করতে পারে। আমার দু‘টি হোটেল রয়েছে। তা থেকে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হয়। আগে জঙ্গলে জুম চাষ করতাম, এখন আর জুম চাষ করতে হয় না।

তিনি জানান, একটি গ্রুপ পাহাড়ে পর্যটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে এখন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কোন চাপ দিচ্ছে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর উপস্থিতি না থাকলে তারা চাঁদা চাইতে পারে বলে তিনি আশংকা করেন।

জানা গেছে, খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বড় দিন ও শুক্র, শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির টানা ছুটিতে রাঙামাটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে। এসব পর্যটকদের পদচারনায় মূখর হয়ে উঠেছে পার্বত্য শহর রাঙামাটি। শহরের পর্যটন কেন্দ্র, আবাসিক হোটেল, বাস টার্মিনালগুলোতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড় দেখা গেছে।

এদিকে শহরের সবকটি হোটেল আগাম বুকিং হয়ে যাওয়ায় রাঙামাটিতে আগত পর্যটকরা আবাসন সংকটে পড়েছেন।

পর্যটন কর্পোরেশন ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে তিন দিনে রাঙামাটিতে ৪০ হাজারের অধিক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। বড়দিনসহ টানা ছুটি থাকায় পর্যটকদের বাড়তি চাপ পড়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, এ তিন দিনে শুধুমাত্র পর্যটন কর্পোরেশনের ঝুলন্ত ব্রীজে দর্শনার্থী প্রবেশ করেছে ১২ হাজারের অধিক। কর্পোরেশনের মোটেল ও কটেজ এর সবগুলো সীট ২৫ডিসেম্বর পর্যন্ত বুকিং হয়ে গেছে। এতে কর্পোরেশনের প্রায় ২০ লক্ষ টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে।

রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক অলোক বিকাশ চাকমা জানান, টানা ছুটি আর ডিসেম্বর মাস হওয়ায় রাঙামাটিতে ব্যাপক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার পর্যটক ঝুলন্ত ব্রীজে প্রবেশ করছে।
আবাসিক হোটেল মালিক নেছার আহমেদ জানান, শহরের প্রায় সব হোটেলের সীট আগাম বুকিং হয়ে গেছে। এতে হোটেল ব্যবসা বেশ চাঙ্গা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এদিকে পর্যটকের আগমন বাড়ায় কাপ্তাই হ্রদের টুরিস্ট বোট চালক, শহরের অটোরিক্সা চালক, উপজাতীয় বস্ত্র বিতান ও হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো ব্যস্ত সময় পার করছে।

পাহাড়ে পর্যটনের সম্ভাবনা সর্ম্পকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা বাবু দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, যদি পর্যটনকে ভালোভাবে বিকশিত করা যায়। তাহলে আমরা পাহাড়ের পর্যটন থেকে সরকারের জাতীয় রাজস্ব খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারি। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের পকেট হাতিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে নেয়। চুরি, সন্ত্রাসীর কারণে পর্যটন বিকশিত হচ্ছে না। তিনি ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে আখ্যায়িত করেন।

খাগড়াছড়ি জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম শফি বলেন, আলুটিলা ইকোট্যুরিজম পর্যটনসহ বিভিন্নস্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আলুটিলা থেকে কোন বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ছাড়াই সেখানে ইকোট্যুরিজম তৈরী করা যাবে। কিন্তু একটি মহল এ পর্যটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন জেলার পর্যটন খাতের উন্নয়নে সম্প্রতি সদর ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার তিন মৌজার ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছিলো। এসব এলাকার উপজাতিদের উচ্ছেদ আতঙ্কে পাহাড়ী আঞ্চলিক সংগঠনগুলো এ নিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে আসছিলো। এজন্য বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন