পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৯ বছর পূর্তিতে কয়েকটি প্রস্তাব

ইব্রাহীম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

ইনসার্জেন্সি নামক শব্দটির হুবহু বাংলা প্রতিশব্দ নেই। অনুরূপ কাউন্টার-ইনসার্জেন্সি শব্দমালারও হুবহু বাংলা প্রতিশব্দ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে ইনসার্জেন্সি শব্দটিকে ব্যবহার না করে, ঐ কর্মযজ্ঞকে, রিভোলিউশনারি ওয়ার-ফেয়ার বলা হয়; এর বিপরীত হবে কাউন্টার রিভোলিউশনারি ওয়ার-ফেয়ার। সার্বিকভাবে এই ধরনের কর্মকা-গুলোকে পৃথিবীর অনেক দেশে লো ইনটেনসিটি ওয়ার-ফেয়ার বলা হয়।

এইরূপ পরিস্থিতিতে, কোনো একটি দেশের বা ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর অংশ, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র পন্থায় তাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বা সংগ্রাম করে বা যুদ্ধ করে। একই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত সরকার বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলোও আন্দোলন বা সংগ্রাম বা যুদ্ধকে দমন করার জন্য অথবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্যবস্তু অনেক সময় হয়, পূর্ণ স্বাধীনতা; আবার অনেক সময় হয় স্বায়ত্তশাসান।

সম্মানিত পাঠকগণ অনেকগুলো স্থান এবং আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি কয়েকটি নাম উল্লেখ করছি। ফিলিপাইনের দক্ষিণে মিন্দানাও প্রদেশে আন্দোলনরত বা সংগ্রামরত মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অথবা মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট, প্রথমে স্বাধীনতা চাইলেও পরে স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং আছেন।

ন্যাশনাল স্যোসালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড নামক দলটি ১৯৫০ এর দশক থেকে সংগ্রাম করছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের স্বাধীনতার জন্য; এখন আন্দোলনটি অতীব ক্ষীণ এবং ম্রিয়মান। নাগাল্যান্ডের একটি জেলা ছিল মিজোরাম; আন্দোলনকারীদের সাফল্য হলো যে মিজোরাম এখন একটি প্রদেশ। ভারতের অন্যতম প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী পশ্চিম সীমান্তে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে বিখ্যাত পর্যটন জেলা দার্জিলিং; দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে ওখানকার গোর্খা অধিবাসীগণ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন গোর্খাল্যান্ড নামক একটি আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের জন্য। আন্দোলনকারীদের সাফল্য হলো, ওখানে আলাদা হিল ডিস্ট্রিক্ট সৃষ্টি হয়েছে এবং একটি হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল আংশিক স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে।

বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী উত্তরে ভারতের দুইটি প্রদেশ যথা মেঘালয় এবং আসাম। উলফা নামক একটি শব্দ বাংলাদেশের প্রায় সকলেই চেনে। উলফা মানে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম। উলফার দাবি ছিল আসামকে স্বাধীন রাজ্য করা শুধু আসামিদের জন্য। সেটা সম্ভব হয়নি। উপরের চার-পাঁচটি উদাহরণের সঙ্গে মিল রেখে আমি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আলোচনায় ফিরে আসছি।

khagrachari-picture1-01-12-2016

পাকিস্তান আমলে ভালোমন্দ সুবিধা-অসুবিধা অনেক কিছুই হয়েছে যার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পাকিস্তান সরকারের উপরে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা চাইলেও ভালো না চাইলেও ভালো, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায় ১৯৭১ সালে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিগণ, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে, তাদের জন্য কিছু সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক বা আইনগত সুযোগ-সুবিধা চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিকটও গিয়েছিলেন। তারা পাননি। অতএব তাদের অসন্তুষ্টি বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে তারা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

একটি রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেছিল যার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সংক্ষেপে পিসিজেএসএস। এই পিসিজেএসএস-এর অঙ্গ সংগঠন ছিল একটি সশস্ত্র উপদল যার নাম শান্তিবাহিনী। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর থেকে পিসিজেএসএস তথা শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এই যুদ্ধটিকে আমরা ইনসার্জেন্সি শব্দ দ্বারা অভিহিত করতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সরকার কাউন্টার ইনসার্জেন্সিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্ট গ্রুপ তথা শান্তিবাহিনী তাদের দাবি-দাওয়া আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক দেরিতে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ, ধরেই নিয়েছিল যে, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র চায় অথবা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত নামক রাষ্ট্রের অংশ হতে চায়।

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখ প্রথমবার, তাদের দাবি-দাওয়া লিখিত আকারে সরকারের হাতে আসে। বিস্তারিত এই ক্ষুদ্র পরিসরের কলামে উল্লেখ করতে পারছি না তবে একটি প্রামাণ্য বই যার নাম “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন”-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ঢাকা মহানগরের বেইলি রোডে সাগর পাবলিশার্স অথবা শাহবাগে পাঠক সমাবেশ অথবা চট্টগ্রামের প্রেস ক্লাব বিল্ডিং এর নিচের তলায় বাতিঘর নামক দোকানে অথবা অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পুস্তক বিক্রেতাদের নিকট অথবা রকমারিডটকম-এ বইটির সন্ধান পাওয়া যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যারাই গভীরভাবে চিন্তা করতে চান, তাদের জন্য এই বইটি প্রয়োজনীয়। বেশি না লিখতে পারলেও একবাক্যে বলবো যে, শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে দাবি করেছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ফেডারেশন করার প্রস্তাব করেছিল। ঐ প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত প্রবণতা ছিল যে, এটি বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে যেতে পারে।

ইনসার্জেন্সি এবং কাউন্টার ইনসার্জেন্সি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংঘাত চলছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বিবিধ কল্যাণমুখী পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা সমাধানের গ্যারান্টি দেওয়া বা নিশ্চয়তা দেওয়া প্রক্রিয়া নয়। শান্তি স্থাপন করতে চাইলে, স্থানীয় জনগণের রাজনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে চাইলে, সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ আলোচনা অবশ্যই করতে হবে। উভয় পক্ষকেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্পষ্টবাদী হতে হবে।

khagrachari-picture2-01-12-2016

এই পরিপ্রেক্ষিতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি আলোচনা চলেছিল। একটি পর্যায়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যতটুকু আনুষ্ঠানিক শান্তি বিদ্যমান সেটি দুইটি ধাপে অর্জিত হয়েছে। প্রথম ধাপ ছিল ১৯৮৭-৮৮-৮৯ সালের শান্তি প্রক্রিয়া। এই প্রথম ধাপের মাধ্যমে তিনটি পার্বত্য জেলায় আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সরকার জেলা পরিষদ গঠন হয়েছিল।

দ্বিতীয় ধাপ ছিল ১৯৯৭ সালের শান্তি প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে, তিনটি জেলা পরিষদের উপরে একটি আঞ্চলিক পরিষদ স্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে; সশস্ত্র আন্দোলনকারীগণ আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পন করেছে (বাস্তবে পূর্ণাঙ্গ হোক বা না হোক)। দ্বিতীয় ধাপের চুক্তির ফলশ্রুতিতে, অনেকগুলো কঠিন প্রশ্ন উঠে এসেছে যেগুলো সমাধান না হওয়ার কারণে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাক্সিক্ষত শান্তি এখনও আসেনি।

২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তারিখ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০১৬ হলো ১৯ বছর। ১৯ বছরে, ঐ শান্তি চুক্তির ধারাগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বা হয়নি সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। মূল্যায়ন করার কর্মটি তিনটি আঙ্গিকে বা তিনটি উৎসে বা তিনটি উদ্যোগে করা যেতে পারে।

প্রথম আঙ্গিক বা উৎস হলো বাংলাদেশ সরকার এবং পিসিজেএসএস এর মধ্যে আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা বৈঠক যেটি মিডিয়াতে কাভারেজ পাবে। দ্বিতীয় আঙ্গিক বা উৎস হলো, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ। সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজও অবশ্যই শামিল হবেন। তৃতীয় উৎস বা উদ্যোগ হতে পারে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে।

বাংলাদেশের দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, চারটি মাঝারি রাজনৈতিক দল এবং অনেকগুলো নিবন্ধিত ছোট রাজনৈতিক দল আছে। কোনো না কোনো একটি রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে একাধিক দিনব্যাপী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্মিলনে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।

যতকিছুই আমরা বলি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটির অনেকগুলো আঙ্গিক আছে যথা (১) মানবিক বা হিউমেনিটারিয়ান, (২) ডেমোগ্রাফিক বা জনসংখ্যা তাত্ত্বিক, (৩) অর্থনৈতিক, (৪) উন্নয়নমূলক, (৫) জাতিগঠনমূলক, (৬) জননিরাপত্তামূলক এবং (৭) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামূলক। এই সকল আঙ্গিককে সমন্বিতভাবে মূল্যায়ন করতে এবং সার্বিক মূল্যায়ন করতে হলে রাজনৈতিক অনুঘটকীয় ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি নিয়ে সমস্যা আছে। অর্থাৎ ভূমির মালিক কে? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। পাহাড়ি ভাইয়েরা মনে করেন সম্পূর্ণ ভূমির মালিক তারা। আমরা মনে করি ভূমির আংশিক মালিক তারা, আংশিক মালিক বাংলাদেশ সরকার এবং আংশিক মালিক বাংলাদেশের আইন মোতাবেক অন্যান্য মানুষ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির কোনো আধুনিক জরিপ হয়নি। সারা বাংলাদেশে তথা সারা দক্ষিণ এশিয়ায় যেই জরিপ প্রক্রিয়াকে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস বলা হয় সেটি পার্বত্য চট্টগ্রামে হয়নি। গত তিরিশ বছরে, বাংলাদেশ সরকার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, বাংলাদেশের অন্যান্য সমতল জেলাগুলো থেকে, ভূমিহীন গরিব বাঙালি পরিবারগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায়, শান্তি বাহিনী প্রচ- রকমের বিরোধিতা এবং বাধার সৃষ্টি করেছিল। শান্তি বাহিনীর আক্রমণে হাজার হাজার বাঙালি নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর আক্রমণে হাজার হাজার উপজাতীয় জনগণ আহত বা নিহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কয়েক হাজার উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের মাটিতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালিদের ওপর শান্তি বাহিনীর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, অনেক স্থানেই বাঙালি জনগণকে তাদের জায়গা-জমি ও বসতভিটা থেকে দূরে সরিয়ে এনে গুচ্ছগ্রামে স্থান দেওয়া হয়।

ফলে বাঙালিদের জায়গা-জমি ও বসতবাড়িগুলো আংশিকভাবে পরিত্যক্ত হয় ও আংশিকভাবে বে-দখল হয়। এই নিয়ে ভূমি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সার্বিকভাবে ভূমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। ভূমি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধগুলো সমাধানের জন্য, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় এই কমিশন দায়িত্ব পালন করবে, এই প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত ৪৫ ভাগ জনগণের স্বার্থের প্রতিকূলে বলে প্রবলভাবে বিশ্বাস করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা বা অন্ততপক্ষে কৃষি জমিগুলোর মালিকানা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতি স্থাপন পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। অপরপক্ষে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতি স্থাপন এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামূলক কর্মকা- পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। আবার এটিও সত্য যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং তার সরকার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করে সেটির দিকে বহির্বিশ্বের অনেকেই তাকিয়ে থাকে।

অতএব চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯তম বছরে ভূমি সমস্যার বিভিন্ন আঙ্গিক এবং বিতর্কগুলোর গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। আমার স্থায়ী সুপারিশ, বাঙালিগণ থাকবেই, বাঙালি জনগণ যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিজে নিজে চলে যায় অথবা তাদেরকে যেন সহজে ভাগিয়ে দেওয়া যায়, ঐজন্য যত প্রকারের পরোক্ষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ অতীতে নেয়া হয়েছে, বর্তমানে চলমান আছে ও ভবিষ্যতে নেওয়া হতে পারে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে, ব্রিটিশ বাণিজ্যিক শক্তি, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশে স্থিত হয়। ঐ ১৭৫৭ সালের জুন মাসের কথা যদি মনে করি, তৎকালীন ভারতবর্ষের আরও কয়েকটি জায়গায় ব্রিটিশরা রাজনৈতিকভাবে স্থিত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী ১০০ বছর ধরে, ব্রিটিশরা তৎকালীন ভারতের বৃহৎ পরিসরে তাদের দখল ও শাসন কায়েম করে।

১৮৫৭ সালে আনুষ্ঠানিভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিদায় হয় এবং লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ রাজ সিংহাসন (ইংরেজি পরিভাষায় ব্রিটিশ ক্রাউন) ভারত শাসনের দায়িত্ব নেয়। ১৮৫৭ সালের পরেও ব্রিটিশদের দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে তৎকালীন ভারতের সীমান্তবর্তী বা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ক্রমান্বয়ে দখলে নিতে থাকে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এবং তাদের মানুষগুলোর সঙ্গে মূল ভারতের মানুষগুলোর সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মানদ-ে প্রভূত তারতম্য ছিল।

তাই ঐ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে শাসন করার জন্য ব্রিটিশরা ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ঐরূপ অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলকে তারা এক্সক্লুডেড এরিয়া ঘোষণা করেছিল অর্থাৎ মূল শাসনের বাইরে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামও এক পর্যায়ে এইরূপ এক্সক্লুডেড এরিয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন সীমান্তের এক্সক্লুডেড এরিয়াগুলো শাসনের জন্য, একেক এরিয়ার জন্য একেক রকম শাসন পদ্ধতি ব্রিটিশরা চালু করেছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১৯০০ সালে তারা একটি শাসন পদ্ধতি চালু করে। যেই আইনের মাধ্যমে চালু হয় সেটিকে বলা হয় চিটাগং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন তথা রেগুলেশন ওয়ান অফ নাইনটিন হানড্রেড। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে এটি আইনের মর্যাদায় ছিল। বাংলাদেশ আমলেও ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে আরও অনেক বিভিন্ন প্রকারের আইন প্রণয়ন হয়েছে যার সঙ্গে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।

অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং সেখানকার মানুষগুলো অনেক প্রকারের আইনের আওতায় পড়েছে এবং সেই আইনগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ধারা আছে যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি কোনো কোনো অজুহাতে বা কারণে মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত এসেছে। মহামান্য হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চ, ভিন্ন প্রকৃতির রায় দিয়েছেন এবং রায়গুলোর কোনো কোনো অংশ অন্য রায়ের কোনো কোনো অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় কোন কোন নিয়মে চলবে বা চলবে না সেটির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এখন ১৯০০ সাল নয়, এখন মোবাইল ফোনের যুগ, এখন ইন্টারনেট-এর যুগ এবং এখন সামন্তবাদ ম্রিয়মান।

আজকের কলামে আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখছি। অতি সংক্ষিপ্ত কলাম। তারপরও দু’চারটি ইশারামূলক কথা বললাম। সর্বশেষ কথাটি হচ্ছে, একটি বাংলা শব্দ নিয়ে। বাংলা শব্দটি হলো ‘আদিবাসী’। এটির ইংরেজি হলো ইন্ডিজেনাস।

আমাদের সুপরিচিত একটি দেশের নাম মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার পুরানো অধিবাসীদেরকে বলা হয় মালয়। মালয়-অধিবাসীগণ মালয়েশিয়ায় অন্যান্য অধিবাসীদের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়লে, মালয়েশিয়া সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মালয়গণকে ভূমিপুত্র বলা হয় অর্থাৎ তারা ঐ ভূমিরই সন্তান।

‘আদিবাসী’ শব্দটির বিশ্লেষণ করলে বলা যায় অরিজিনাল ইনহেবিটেন্স বা যারা পুরনো বা শুরুর থেকে বসবাস করছেন তারা। একটি ইংরেজি শব্দ আছে যথা অ্যাবোরিজিনালস। এই অ্যাবোরিজিনালস শব্দটিকে বদলিয়ে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইন্ডিজেনাস শব্দ এনেছেন। যদি শুধু ইংরেজি শব্দ হতো, তাহলে আপত্তি ছিল না।

২০০৭ সালের পর থেকে যদি কোনো দেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকে ইন্ডিজেনাস শব্দ দিয়ে আইনগতভাবে অভিহিত করা হয়, তাহলে সেই ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর অনেকগুলো অধিকার জন্মায়। জনগোষ্ঠী যদি অধিকার পায় তাতে কারো আপত্তির কিছু নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই অধিকারগুলো দেশের বা রাষ্ট্রের বা বৃহত্তর জাতির অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অ-বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অতীতে উপজাতীয় বা ইংরেজিতে ট্রাইবাল বলতাম। তারপরে তাদেরকে শুধু পাহাড়ি বলতাম। তারপর তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা শুরু করলাম। কিন্তু ঐ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ চাচ্ছেন বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে ‘আদিবাসী’ বা ‘ইন্ডিজেনাস’ বিশেষণ দিয়ে অভিহিত করুক এবং স্বীকৃতি দিক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য এইরূপ একটি ঘোষণা দেওয়া বা স্বীকৃতি প্রদান করা অনেক জটিল কাজ।

কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আদিবাসী’ ঘোষণা দিলে, বাংলাদেশ সরকারের উপরে অনেকগুলো আইনগত সীমাবদ্ধতা আরোপিত হবে। অপরদিকে ঐ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ অনেকগুলো আইনগত সুবিধা পাবে। এই সীমাবদ্ধতা এবং সুবিধা উভয়টি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিপদজনক ও ক্ষতিকারক।

জেনেশুনে বাংলাদেশ নিজের বিপদ ডেকে আনা সমীচীন নয়। জেনে হোক বা না জেনে হোক, বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি অংশ সুশীল সমাজের একটি অংশ, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করেন। সামর্থ্য থাকলে বা বিপদের সম্ভাবনা না থাকলে অনেকেই ঐরূপ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আদালতে যেতেন। কারণ, যেটি সংবিধান সমর্থন করে না বা রাষ্ট্রীয় আইন সমর্থন করে না সেটি তারা করছেন।

অতএব, শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯ বছর পূর্তিতে এসে আমাদেরকে এই বিষয়টির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ বিডিআর, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর বহু রক্ত ঝরেছে। হাজার হাজার বাঙালি এবং পাহাড়ি ভাইবোন প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়েছেন নির্যাতিত হয়েছেন শান্তির লক্ষ্যে দেশের নিরাপত্তার লক্ষ্যে।

অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সর্বপ্রকারের জনগণের মনের কষ্ট দূর করার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপকে শক্তিশালী করতে হবে, ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপের দুর্বলতাগুলোকে দূরীভূত করতে হবে। পৃথিবীতে ঘোষিত শত্রু যেমন থাকে তেমনই বন্ধুবেশে শত্রুও থাকে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে এটি কোনো ব্যতিক্রম নয়। এই কথা খেয়াল রেখে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পর্যালোচনা করতে হবে। আমি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন বা রিভিশন প্রস্তাব করছি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন