পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তি ও উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে হবে

সাখাওয়াত হোসেন

এম সাখাওয়াত হোসেন

প্রায় সাত বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম কয়েকটা দিন কাটাতে। গিয়েছি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে। খাগড়াছড়ি, কাপ্তাই, রাঙামাটি, বাঙ্গাল হালিয়া-বান্দরবান পাহাড়ি রাস্তা ধরে পৌঁছেছিলাম খাগড়াছড়ি থেকে বান্দরবান।

প্রায় এক যুগ আগে রাঙামাটি থেকে বান্দরবান যেতে হলে চট্টগ্রাম ঘুরে যেতে হতো। কাপ্তাই যেতে হলেও একইভাবে অথবা রাঙামাটি থেকে জলযানে কাপ্তাই পৌঁছাতে হতো। সময়ও লাগত অনেক। এই রাস্তাটি এখন তিনটি জেলাকেই সংযুক্ত করেছে। রাস্তাটির নির্মাণকাজ নব্বইয়ের দশকে শেষ হয়েছিল, কিন্তু তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেটা খুব ব্যবহার করা হতো না। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে যায়। ফলে এখন এ রাস্তা কার্যকর বলে বিবেচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার সর্বসাধারণের এখন চট্টগ্রাম ঘুরে নয়, সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর ২০০৮ এবং ২০০৯–এ নির্বাচন কমিশনের কাজে গিয়েছিলাম এই তিন জেলা সদরে। তারপর আর যাওয়া হয়নি। ১৯৯০-৯২-এ কর্তব্যরত ছিলাম বান্দরবান সেনা রিজিয়নে, কমান্ডার হিসেবে। ওই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান চলছিল। পার্বত্য চুক্তি অন্তত সে পরিস্থিতির ইতি টেনেছে।

১৯৯৭ সালে যে পার্বত্য চুক্তি বাংলাদেশের সরকার এবং পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল, তার প্রচেষ্টা চলেছিল আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। তবে সে প্রচেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ না হলেও চুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ওই সময়ের সরকার এই চুক্তি সম্পাদন করে। অবশ্যই চুক্তি সম্পাদনের কৃতিত্বের দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার। ওই সময়ে ওই চুক্তির বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় ছিল।

পার্বত্য চুক্তির পর যোগাযোগব্যবস্থার যে উন্নতি হয়েছে, তার সুফল পেতে শুরু করেছে এলাকার ১১টি ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী। বর্তমানে প্রতিটি জেলা সদরের সঙ্গে সব উপজেলার সড়ক ও নৌপথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে, যা এক দশক আগেও সম্ভব ছিল না।

হালে বান্দরবান জেলা সদরের সঙ্গে সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা থানচির সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। থানচি থেকে আলীকদম, লামা উপজেলাও এখন অভ্যন্তরীণ সড়ক দিয়ে যুক্ত হয়েছে। বছর দুই আগেও এই দুই উপজেলা প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। বান্দরবান সদর থেকে কক্সবাজার সড়ক হয়ে যেতে হতো এই দুই উপজেলায়। সংক্ষেপে বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে যেসব জায়গায় হেলিকপ্টার ছাড়া হাঁটাপথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন লেগে যেত, সেসব জায়গায় বর্তমানে কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছাতে পেরেছি।

যোগাযোগ অবকাঠামোর সঙ্গে বাজারব্যবস্থার যেমন উন্নতি হয়েছে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিশেষ করে দক্ষিণের জেলা বান্দরবানে পর্যটনের যে দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, তা অচিন্তনীয় ছিল। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে যে কয়েকটি জায়গা পর্যটনের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল, আজ সেসব জায়গায় প্রতিদিন শত শত লোকের পদচারণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এদের সমাগম। পর্যটনকে কেন্দ্র করে আশপাশের উপজাতীয় গ্রামগুলোতে হস্তশিল্প গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র। এরই প্রেক্ষাপটে স্থানীয়ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

একই সঙ্গে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে প্রতিটি জেলা-উপজেলায়। শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরিত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটগুলো। চাকমা অধ্যুষিত রাঙামাটি জেলা পুরোনো ও বৃহত্তর জেলা শহর। যোগাযোগের ব্যবস্থা অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভালো থাকলেও একটি মাত্র কলেজ ছিল সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে। তবে এ পর্যন্ত ওই জেলার ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯৭৯ জন (২০১১) জনসংখ্যার জন্য রয়েছে ২৯১টি সরকারি এবং ১২০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২২টি জুনিয়র স্কুল, ৬টি সরকারি ও ৪৫টি বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ২টি সরকারি ও ১৩টি বেসরকারি কলেজ, ৭টি কারিগরি স্কুল, ১টি মেডিকেল কলেজ এবং হালে প্রতিষ্ঠিত কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের বিরোধিতা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। বান্দরবান জেলায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৫ জন (২০১১) জনসংখ্যার জন্য দুটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি কলেজ এবং প্রায় হাজার খানেক প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে একটি মুরং বা ম্রো আবাসিক হাইস্কুলও রয়েছে। অনুরূপভাবে খাগড়াছড়ি জেলার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।

একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম বলতে শুধু রাঙামাটি বা কাপ্তাইকে ধারণায় নেওয়া হতো, এখন তেমন নেই। খাগড়াছড়ি, মংসার্কেল, ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাঙামাটি চাকমা সার্কেল এবং বান্দরবান মারমা সংখ্যাগরিষ্ঠ বোমাং সার্কেল আলাদা আলাদা সত্তায় গড়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্থানীয় নৃগোষ্ঠী নেতৃত্ব, যাদের বেশির ভাগ সহ-অবস্থানে উন্নয়নের পক্ষে।

এত সব উন্নয়নের ভিত পার্বত্য চুক্তি হলেও সম্ভব হয়েছে বিগত দিনগুলোতে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর প্রচেষ্টায়। অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানে সমগ্র দেশের তুলনায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। তবে ইউপিডিএফ নামে যে গোষ্ঠীটি পার্বত্য চুক্তির বিরোধী, তাদের তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বলপূর্বক চাঁদা তোলার ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনজীবন অতিষ্ঠ।

এত উন্নয়নের পরও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মনঃকষ্ট রয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ ভূমি ব্যবস্থাপনা ও স্বত্বাধিকার নিয়ে। এখনো চলছে ভূমি জবরদখলের ঘটনা, যার সঙ্গে শুধু প্রভাবশালী বাংলা ভাষাভাষীরাই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী নৃগোষ্ঠীর নেতারাও রয়েছেন। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের প্রধান সমস্যাও ভূমি–সংক্রান্ত, যা তিনটি আইনের, যার মধ্যে একটি স্থানীয় প্রচলিত প্রথাগত ডামাডোলে আরও জটিল হয়েছে। এ সংকট সহজে সমাধান হওয়ার নয়। যদিও চুক্তি মোতাবেক যেকোনো অধিগ্রহণের পূর্বানুমতি জেলা পরিষদের, তথাপি জেলা পরিষদ এ বিষয়ে অকার্যকর রয়েছে। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি অন্তরায় নয়, অন্তরায় ভূমির বিষয়ে দ্বৈত বেসামরিক প্রশাসন। যেসব জায়গায় স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকার কথা, সেগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাধা হয়ে রয়েছে।

পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে প্রথম নির্বাচনের পর আর নির্বাচন হয়নি, যার কারণে প্রায় ২৪টি বিষয় হস্তান্তরিত হলেও পরিষদ কার্যকর করতে পারছে না। জেলা পরিষদগুলো নির্বাচিত ও কার্যকর হলে চুক্তি বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। একইভাবে কাউন্সিলের নির্বাচনও এখন হয়নি নানা জটিলতার কারণে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা পরিষদগুলোকে ক্ষমতায়ন করলে অনেক ছোটখাটো সমস্যার সমাধান স্থানীয় পর্যায়েই সম্ভব। সে কারণেই অন্তত এসব পরিষদের নির্বাচনের অন্তরায়গুলো দূর করা আবশ্যক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় যথেষ্ট স্থিতিশীল। তবে নতুন উপসর্গ ইউপিডিএফের নামে সংঘটিত সশস্ত্র তৎপরতাকে রাজনৈতিক ও স্থানীয়ভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য চুক্তির পক্ষগুলো এবং যারা পক্ষের বাইরে রয়েছে সেসব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি যা এখন দৃশ্যমান, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সবার কর্তব্য। ওই অঞ্চলের কৃষ্টি, ঐতিহ্য আর মানুষগুলোর জীবনযাত্রা অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন প্রয়োজন। যেকোনো উন্নয়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নৃগোষ্ঠীর মানুষদের সম্পৃক্ততা কাম্য। উসকানিমূলক বক্তব্য বা কর্মকাণ্ড নয়, সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের মাধ্যমে অনেক জটিল বিষয়ের সুরাহা সম্ভব। আমার চাকরিকাল ১৯৯০-৯২-এর এতগুলো বছর পরও সাধারণ নাগরিক হিসেবে বান্দরবানে সর্বসাধারণের কাছ থেকে যে অভূতপূর্ব উষ্ণতা পেয়েছি, তাতে আমি নিশ্চিত যে আন্তরিক হলে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা যেমন করা যায়, তেমনি ছোট-বড় সমস্যার সমাধানও সম্ভব।

এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
[email protected]

♦ সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন, খাগড়াছড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন