পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চল- বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলনে বক্তারা

13187814_1180625511949781_1225968215_n

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

এশিয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সামরিকায়ন সংঘাত ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম (ইউএনপিএফআইআই) পঞ্চদশ বার্ষিক সম্মেলনে অভিমত প্রকাশ করেছেন দি এশিয়া ইন্ডিজিনাস পিপল প্যাক্টের সেক্রেটারি জেনারেল জোয়ান কার্লিং।

ইন্টার প্রেস সার্ভিস নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী এশিয়া অঞ্চলে বাস করে। তারা এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনবৈচিত্র এনেছে। কিন্তু তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে স্বীকৃতি, সামরিকায়ন ও ভূমির উপর অধিকার। এরমধ্যে বাংলাদেশের ১১ আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চল।

আদিবাসী জনগণঃ দ্বন্দ্ব, শান্তি, ও সমাধান – এই থিম নিয়ে গত ৯ মে সোমবার জাতিসংঘ সদর দফতরে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের পঞ্চদশ অধিবেশন শুরু হয়েছে। দুই সপ্তাহ ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহস্রাধিক প্রতিনিধি এ অংশগ্রহণ করছেন যাদের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, কর্মসূচি ও ফান্ড, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি, জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, আদিবাসী পার্লামেন্টারিয়ান, স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারসহ আদিবাসী প্রতিনিধি রয়েছেন।

সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রতিনিধি দলের একটি অংশ সাইড লাইন আলোচনায় এশিয়ার প্রেক্ষাপটে মূল থিমের উপর আলোচনা করেন।


আরও পড়ুন : প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ বাড়ছে


ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজিনাস এফেয়ার্সের(আইডব্লিউজিআইএ)মতে, বাংলাদেশের এক নবমাংশ ভূমিতে বসবাসকারী এক শতাংশ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ অবস্থান করে। প্রথমদিকে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য জনসংহতি সমিতির দুই দশকের অধিকার ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীর লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে সেখানে সেনাবাহিনী মোতাযেন করা হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে সেখান থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলা হলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

13162219_1180641591948173_1973189504_n

সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘ এ চুক্তির ১৮ বছর পার হলেও চুক্তির প্রধান প্রধান শর্তগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। সামরিক বাহিনী সেখানে থাকতে পারে, কিন্তু সামরিক শাসন চলতে পারে না। ’।


আরও পড়ুন : দল ত্যাগ করায় নানিয়ারচরে ইউপিডিএফ কর্মী খুন


জাতিসংঘ নিযুক্ত স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার লার্স এন্ডার্স বাযের তার রিপোর্টে শান্তিচুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের সরকারী ব্যর্থতা ও ওই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর বিস্তারের কথা তুলে ধরেছেন।

দ্রং বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর দ্বারা ভিন্নমত দমন, নির্যাতন, গ্রেফতার ও ভূমি দখলের মতো ঘটনা ঘটছে। আদিবাসীদের বসত ও জমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে তাদের জমি অস্থানীয়দের লিজ দেয়া হচ্ছে’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘পর্যটন শিল্পের সামরিক সম্পৃক্ততা আদিবাসীদের জমি বাজেয়াপ্ত ও ধংসে ভূমিকা রাখছে’।

‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সেনাকল্যাণ সংস্থা আবাসন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা খাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সরকারী অনুদান ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রামে নীলগিরির মতো বিলাসবহুল রিসোর্ট নির্মাণ করেছে। এর নির্মাণ কালে সেনাবাহিনী আদিবাসীদের ফলন্ত বাগান, দোকান ও নিকটস্থ স্কুল ধংস করেছে’ বলেও তিনি জানান।


আরও পড়ুন : পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি আওয়ামী লীগের


উল্লেখ্য, গত ৯ মে সোমবার জাতিসংঘ সদর দফতরে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের পঞ্চদশ অধিবেশন শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজেদের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত আদিবাসী জনগণের পূর্ণ অধিকার পুনরুদ্ধারে নতুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন।

এক ভিডিও বার্তায় তিনি এবারের থিমকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থায়ী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পূর্বশর্ত। জাতিসংঘ স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সাথে আলোচনা শুরু করার জন্য তিনি সাধারণ পরিষদকে আহ্বান জানান। বান কি-মুন আরো বলেন, নারীসহ আদিবাসীরা যাতে অংশগ্রহণ করে এবং উপকৃত হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট সুয়েন জারগেনসেন সকল সদস্য রাষ্ট্রকে উৎসাহিত করে বলেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে বলেই শুধু নয়, যেহেতু তারা বৈষম্যের কারণে প্রান্তিক ও বিপন্ন, তাই তাদের সাথে সদস্যরাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ২০৩০ সালের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আদিবাসী জনগণ যাতে বাদ না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। “লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড” কথাটির প্রতিফলন থাকতে হবে।

এবারের অধিবেশনে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার, টেরিটরি ও সম্পদের অধিকার, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও পরিচয়ের অধিকার নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

অধিবেশনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট মগেন লুকটফ বলেন, যখন আদিবাসীরা অধিকারের কথা বলেন, তখন তাদের আক্রমণের টার্গেটে পরিণত করা হয়। আদিবাসীদের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সকল বিষয়ে জাতিসংঘে তাদের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত দেন।

অধিবেশনে আরো বক্তব্য রেখেছেন কানাডার জাস্টিস মিনিস্টার মিস্ জোডি উইলসন রেবোল্ড, গুয়াতেমালার শ্রম ও সামাজিক সুরক্ষা মন্ত্রী অরা লেটিসিয়া তেলেগুয়ারিও এবং জাতিসংঘ আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল মি. উ হংবো।

এই অধিবেশনে সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে আদিবাসী প্রতিনিধিদের অর্থপূর্ণ আলোচনা ও সংলাপের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

বাংলাদেশ থেকে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ আটজন প্রতিনিধি এতে অংশ নিচ্ছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কাউন্সিলর এটিএম রকিবুল হক এতে অংশগ্রহণ করছেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অধিবেশনে যোগ দেবেন। অধিবেশন চলবে ২০ মে পর্যন্ত।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, জাতিসংঘ, সামরিক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন