Notice: Trying to get property 'post_excerpt' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 53

Notice: Trying to get property 'guid' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 55

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধস, অযাচিতভাবে প্রশ্নের তীর বাঙালিদের দিকে


পারভেজ হায়দার ::
গত ১১-১৩ জুন ভারি বর্ষণের সময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজারে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের করণে প্রাণহানির ঘটনা একবারে নতুন না হলেও এ বছরের পাহাড়ধসজনিত বিপর্যয় ইতিপূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে নিঃসন্দেহে রাঙ্গামাটিতে এ বছর প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের এই বিষয়টি সামনে রেখে বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশনে টক-শোসমূহে বক্তাদের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের অযাচিত মন্তব্য এবং বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টগুলোতে আপাত দৃষ্টিতে সাম্প্রতিক পাহাড়ধসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। গত ১৬ জুন ২০১৭ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ছয় বছরে নিহতদের ৬৪ ভাগ বাঙালি’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বন ও পাহাড় কেটে যত্রতত্র বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়েছে। অধ্যাপক আখতার পার্বত্য অঞ্চলের এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করে উপরোল্লেখিত মন্তব্য করেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি একেবারে সরলীকরন করে পক্ষপাতমূলকভাবে কোন একটি জনগোষ্ঠীর উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর কথা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের ৭টি স্থানে পাহাড় ধসের কারণে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে ৪টি পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়, ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ও সিলেটে ৯৪ জন মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ২০১৫ সালের ২৬-২৭ জুন টানা বর্ষণ, ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ১৯ জনের মৃত্যুর বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পাহাড়ধসজনিত এই প্রাণহানির বিষয় বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে, পাহাড় ধসের ভৌগোলিক বিপর্যয় শুধুমাত্র পার্বত্য জেলাগুলোতে নয়, পাহাড় পরিবেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থানেই ঘটছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভৌগোলিক দিক দিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখানে সমতল ভূমির পাশাপাশি উঁচু-নিচু, ছোট-বড় অনেক পাহাড় বা টিলা রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাধারণত মাটি এবং বালু মিশ্রিত, এসকল পাহাড়ের মাটি এটেল মাটির মত আঠালো নয়। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মতো পাথর পরিবেষ্টিত নয়। এই পাহাড়গুলোর মাটি কোন নির্দিষ্ট শক্ত অবলম্বনের অনুপস্থিতিতে ভারি বর্ষণের ফলে সহজে ধসে পড়ে। এখানে সহায়ক অবলম্বন বলতে ব্যাপক বনায়নই গ্রহণযোগ্য সমাধান। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পার্বত্য চট্টগ্রামেও পড়েছে। অনেক বছর আগে সাধারণত পাহাড়ের গ্রাম অঞ্চলে ‘সনাতনী উপজাতী বন ও কৃষি সভ্যতার’ ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিক্ষা থেকে Watershed Management ও পরিবেশ সংরক্ষণের কলাকৌশল অনুসরন করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের ঘরবাড়ি তৈরী করত। এবিষয় অনস্বীকার্য যে এ ধরনের লোকজ জ্ঞানকেই ১৯৯২ সালে প্রথম বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে Traditional Scientific Knowledge হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। অনেক আগের সেই সময়গুলোতে এই সনাতনী ধারা অবলম্বন করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীরা পাহাড়ের মাটি না কেটে খুঁটির ওপর ‘টং ঘর’ তৈরি করা হতো। এছাড়া তাদের ধর্মীয় একটি সংস্কারও ছিল সেই সময়গুলোতে। প্রয়াত বিশিষ্ট উপজাতী গবেষক ও লেখক অমরেন্দ্র লাল খীসার গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, অধিকাংশ গোত্রের উপজাতীরা ‘ধরিত্রীকে আঘাত করে মাটি কর্ষণ করাকে পাপ মনে করতো’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপজাতীদের জীবনে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, বাসস্থান ও পোষাক পরিচ্ছেদে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাতেও উপজাতী যুবক-যুবতীদের জিন্স, টি-শার্টেই স্বাচ্ছন্দবোধ করতে দেখা যায়। এখানে আরো একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। অনেক আগে দুর্গম পাহাড় এবং প্রত্যন্ত এলাকায় যখন কোন রাস্তা-ঘাট ছিল না, পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পেত না। সাম্প্রতিক কয়েক দশকের ক্রম উন্নয়নের অন্যতম হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট তৈরি। বর্তমান সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় পাহাড়িদের উৎপাদিত পণ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যপক উন্নয়নের ফলে শহর এলাকায় পরিবহন সহজেই সম্ভব হয়। পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাচ্ছেন এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও ক্রমান্বয়ে আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিতে আগ্রহবোধ করেন। তার অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অর্থাৎ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা ছিল সময়ের দাবী।

প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই রাস্তাগুলো তৈরি করেছেন তারা কি যথেষ্ঠ নিরাপদভাবে রাস্তা তৈরি করতে পেরেছেন কি না? এর উত্তর হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যেকোন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নির্ভরশীল। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাগুলো তৈরি করতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিবেচনায় পাহাড়ের পাদদেশসমূহ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ জ্ঞানে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তার দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে পানি সঞ্চালনের সু-ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। যতটুকু জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পানি সঞ্চালনের জন্য উপযুক্ত কার্যকর ড্রেন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়টি ভালভাবে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে প্রতিনিয়ত রাস্তাগুলোর রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা তারা ভালোভাবেই করছেন। তাই, পাহাড় ধসের মূল কারণ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আধুনিকতার অন্যতম নিয়ামক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক বাসস্থান তৈরি, পর্যটনের উন্নয়ন ইত্যাদি একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০০৭ সালের ভূমিধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে যে সমস্ত সমস্যা চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারি বর্ষণ, পাহাড়ের মাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকা, উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, পাহাড় থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি এবং মাটি অপসারনের দুর্বলতা ইত্যাদি। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, অতি বৃষ্টিপাতও বালি/মাটি মিশ্রিত পাহাড়ধসের অন্যতম ‘কারণ’ হিসাবে চিহ্নিত। নাসার তথ্যমতে, গত ১২-১৪ জুন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৫১০ মিলি অর্থাৎ ২০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ১৭ জুন ২০১৭)। শুধুমাত্র ১৩ জুন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, একদিনে রাঙ্গামাটিতে ৫২৪ মিলি বৃষ্টিপাত হয় (ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ১৪ জুন ২০১৭)। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে দৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রাঙ্গামাটির জুন মাসের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো, ৪৫৩.১ মিলি (২০১৬), ৩৯৭.৩ মিলি (২০১৫), ৩৩৬.৭ মিলি (২০১৪), ৩১৬.৯ মিলি (২০১৩), ৩৩৫.৪ মিলি (২০১২)। অর্থাৎ পাহাড়ধস জনিত মানবিক বিপর্যয়ের ওই দিনগুলোতে একদিনের গড় বৃষ্টিপাত অন্যান্য বছরের জুন মাসের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পূর্বের অভিজ্ঞতার বিবেচনায় বর্তমান বছরের পাহাড়ধসের কারণ হিসাবে শুধুমাত্র একটি জাতিগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাঙালিদের দায়ী করা নিতান্তই অবিবেচনা প্রসূত, অপরিপক্ক চিন্তা-ভাবনা বলে প্রতীয়মান হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে গত শতকের ৭০ এবং ৮০ দশকে তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে সকল বাঙালিকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল, তাদের পরিবার প্রতি পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন খাস জমি থেকে সমতল ভূমি হলে ২.৫ একর আবার পাহাড় এবং সমতল মিশ্র ভূমি হলে ৪ একর ও সম্পূর্ণ পাহাড়ি ভূমি হলে ৫ একর করে জমির বন্দোবস্তি দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসংগে উল্লেখ করা যেতে পারে, খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি এলাকার ৩টি মৌজায় ১৮,৮৬৪ একর, বাবুছড়া এলাকার ৬টি মৌজায় ১৭,৬৭৩ একর, বড় মেরুং এলাকার ২টি মৌজায় ১১,৮৯৩ একর, ছোট মেরুং এলাকার ১টি মৌজায় ১০,৪৮১ একর, খাগড়াছড়ি সদর এলাকার গোলাবাড়ী মৌজায় ১৯,৬১৬ একর, মহালছড়ি এলাকার ৭টি মৌজায় ২৬,৬২৫ একর, রামগড় এলাকার ২টি মৌজায় ২৬,৬৭৪ একর, আলুটিলা এলাকার ৯টি মৌজায় ২৯,৩৪৭ একর, মানিকছড়ি এলাকার ৭টি মৌজায় ২২,৫৪৪ একর, লক্ষীছড়ির ৫টি মৌজায় ১৩,১৬৫ একর, কাপ্তাই এলাকার ২টি মৌজায় ১৭,৮৭৯ একর, রাঙ্গামাটি সদর এলাকার ৪টি মৌজায় ৭,২১৬ একর, বুড়িঘাট এলাকার ৬টি মৌজায় ১০,৫৯৪ একর, জুরাছড়ি এলাকার ৪টি মৌজায় ৯,৩০০ একর, ভূষণছড়া এলাকার ৬টি মৌজায় ২৬,৭১৭ একর, সুভলং এলাকার ২টি মৌজায় ১০,৯০৫ একর, লংগদু এলাকার ২টি মৌজায় ৮,৬৯৭ একর, কাচালং এলাকার ১টি মৌজায় ১৪,০০০ একর এবং আটারকছাড়া এলাকার ১টি মৌজায় ২,৬৩৩ একর জমি বাঙালিদের বন্দোবস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সময়ে শান্তিবাহিনীর আক্রমণ এবং নিরাপত্তা জনিত কারণে অধিকাংশ বাঙালি পরিবারকে সরকার তাদের বন্দবস্তিকৃত জমিগুলোতে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পায়নি। ১৯৮৬ সাল পরবর্তী সময়ে তাদের নিরাপত্তা বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। তবে সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনেক বাঙালি অবৈধভাবে রাস্তা সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকছে। একই সাথে উপজাতীয়দের অনেকেও বাঙালিদের মতো পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। এ ক্ষেত্রে, উভয় সম্প্রদায়ই সনাতন উপজাতীয়দের বহুল প্রচলিত লোকজ প্রথা অর্থাৎ Watershed Management অনুসরণ করে, অর্থাৎ পাহাড়ের মাটি না কেটে খুটির উপর ‘টং ঘর’ জাতীয় ঘরে বসবাস করছে না। বাঙালি/পাহাড়ি উভয় সম্প্রদায় পাহাড় কেটে অনিরাপদভাবে তাদের বসতবাড়ি নির্মাণ করে অবস্থান করছে। প্রথম আলোর ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় পাথুরে না হলেও, গাছের আচ্ছাদন এ পাহাড়কে ধস থেকে রক্ষা করে, কিন্তু পাহাড় দিন দিন ন্যাড়া হয়েছে’। প্রকৃতপক্ষে, এই পাহাড় ন্যাড়া হওয়ার পিছনে উপজাতীয়দের বহুল প্রচলিত জুম চাষই দায়ী। জুম চাষের জন্য একটি পাহাড়কে উপযোগী করার জন্য পাহাড়ের সমস্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর ওই জমিতে ক্রমান্বয়ে জুম চাষ করা হয়। পূর্বে পার্বত্য এলাকায় যখন জনসংখ্যা কম ছিল, পাহাড়িরা এক বছরে একটি পাহাড় পুড়িয়ে জুম চাষ করার পর পরের বছরে অন্য একটি পাহড়ে জুম চাষ করতো। এভাবে প্রতি বছর পাহাড় পরিবর্তন করে প্রথম পাহাড়ে ফিরে আসতে তাদের ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগতো। তাই একটি পাহাড় জুম চাষের ফলে প্রথম বছর ভূমি ধসের ‘কারণ’ তৈরি করলেও ১৫ থেকে ২০ বছর পর ঐ জমিতে ফিরে আসার কারণে মধ্যবর্তী বছরগুলোতে নতুন করে প্রাকৃতিকভাবেই বনাঞ্চল তৈরি হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে উপজাতীয়দের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবার কারণে ২ থেকে ৩ বছর পর পর একই পাহাড়ে পুনরায় জুম চাষ করার ফলে সেখানে প্রাকৃতিকভাবে নতুন বনাঞ্চল তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকছে না। তাই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এর পাহাড় ধসের পিছনে জুম চাষ প্রথা অন্যতমভাবে দায়ী।

এখানে উল্লেখ্য, জুম চাষ শুধুমাত্র উপজাতীয়রাই জনগোষ্ঠীরা করে থাকে, বাঙালিরা জুম চাষে অভ্যস্ত নয়। গত ১১-১৩ জুন রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত পাহাড়ধসের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বাঙালি ও পাহাড়িদের অনিরাপদভাবে তৈরিকৃত বাসস্থান এলাকায় পাহাড়ধসের পাশাপাশি, জনবসতিহীন অনেক পাহাড়েও ব্যাপক ভূমিধস হয়েছে। তাই এ বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বাঙালি বা পাহাড়িদের বসতি স্থাপনই ভূমিধসের অন্যতম কারণ নয়, যদি তাই হতো তাহলে যে সকল পাহাড়ে বসতি স্থাপিত হয়নি, সেই পাহাড়গুলোতে ভূমি ধস হতো না।

উপর্যুক্ত আলোচনায় এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টক-শোগুলোতে লেখক এবং বক্তাগণ প্রকৃত গবেষণাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপন না করে অবিবেচনা প্রসূত ও অপরিপক্ক বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে করে পাহাড়ধসের প্রকৃত কারণ অপ্রকাশিত থেকে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে ‘শুধুমাত্র পাহাড়ি’ অথবা ‘শুধুমাত্র বাঙালিরা’ দায়ী একথা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে যুগের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসা খুবই স্বাভাবিক। আধুনিকতার এ পরিবর্তন ছিল সময়ের দাবি, যা বাঙালি বা পাহাড়ি কারো পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

২০০৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভূমিধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি কর্তৃক পাহাড়ের ৫ কি. মি. এর মধ্যে আবাসিক প্রকল্প গড়ে না তোলা, পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন, ঢালু পাহাড়ে গাইড ওয়াল নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারনের ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কি. মি. এর মধ্যে ইটের ভাটা নিষিদ্ধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। যতটুকু জানা গেছে, এবারও পাহাড়ধসের সমস্যা চিহ্নিত ও করণীয় নির্ধারনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা’কে প্রধান করে ২১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি নিশ্চয়ই পাহাড়ধসের সঠিক কারণ চিহ্নিত করতে এবং পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সুপারিশ করবেন। এর মধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে মনগড়া বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করা সমীচীন নয়। বর্তমানে পাহাড়ধসে পাহাড়ি বাঙালি উভয় সম্প্রদায় তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। সরকার প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় থেকে উত্তোরণে এবং ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলোকে স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমাদের সকলেরই উচিত সংঘটিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতিকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থান্বেষী আচরণ পরিহার করা। এই দেশ আমাদের সকলের। পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠী এই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক। পার্বত্য এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এই সন্ধিক্ষণে ব্যক্তিগত পছন্দ ও মতামতকে ঊর্ধ্বে রেখে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ একসাথে কাজ করবে, এটাই কাম্য।

লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক    

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন