পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে ‘যতো দোষ-বাঙালী ঘোষ’ কৌশলের প্রয়োগ

সন্তোষ বড়ুয়া, রাঙামাটি থেকে:

বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘যত দোষ- নন্দ ঘোষ’। বাঙালীর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রবাদে প্রভাবিত হয়েই জানিনা লিখেছিলেন কিনা যে,

  • “ভুতের মতোন চেহার যেমন নির্বোধ অতি ঘোর
  • যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন, কেষ্টা বেটায় চোর”।

তবে সব বাঙালীর চেহারা হয়তো নন্দ বা কেষ্টর মতো নয়। কিন্তু অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব বাঙালীর ভাগ্যই যেন নন্দ বা কেষ্ট’র মতো। এটাই যেন তাদের বিধিলিপি। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যে অপকর্ম যারাই করুক না কেন উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কোনো বাছবিচার ছাড়াই শুরুতে নন্দ বা কেষ্ট’র মতো বাঙালীদের উপর দোষ চাপিয়ে তাদের শাস্তি দাবী করে।

বক্তৃতা, বিবৃতি, মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করে মিডিয়া হাইপ করে বাঙালীদের চরিত্রে কলিমা লিপ্ত করার চেষ্টা করে। পরবর্তীকালে দেখা যায়, এসব প্রচারণার অধিকাংশই সত্য নয়। বিশেষ করে অধিকতর তদন্তে যখন এসব অপকর্মের সাথে পাহাড়ী সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা চোখে পড়ে তখন আর তারা ‘টু’ শব্দটি করে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন বাঙালীরা মনে করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের উপর যেকোনো ধরণের অপরাধ হলেই তার দায়ভার বাঙালীদের উপর চাপিয়ে একটি গোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে উঠে পড়ে লাগে। তাদের মূল লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে উপজাতি-বাঙালী সম্প্রীতি ধ্বংস করা এবং বাঙালীদের দায়ী করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী বিতাড়ন আন্দোলন গড়ে তোলা।

জাতিগত বিভেদ ভুলে সাধারণ বাংগালী এবং উপজাতিদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকলেও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের এরুপ নানান নোংরা রাজনীতির কারনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাংগালীদেরকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা।

এমনকি নিজেরাই কোন একটি অপরাধ সংঘটিত করে সেটাতে নানান রং চড়িয়ে বাংগালীদেরকে সরাসরি দোষারোপ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করে মিডিয়া এবং জনগণের নজর কাড়ার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষতঃ ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ বা আইডি ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংগালীদেরকে উৎখাত করার লক্ষ্যে নানান মিথ্যাচার, গুজব এবং বিভ্রান্তিকর পোস্ট প্রদান করে আসছে।  এরকম ঘটনার মধ্য থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক:

গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে আপন ভগ্নিপতির ভাড়া বাসায় বোন ও ভগ্নিপতির অনুপস্থিতিতে গলা কেটে হত্যা করা হয় খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইতি চাকমাকে। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল এ হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি  করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি বাঙালিদের দায়ী করে নানা রং ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে নানা অপপ্রচার চালায়। এমনকি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের ফেসবুকের চাকমা পেইজগুলোতেও আলোচনায় স্থান পায় ইতি চাকমা। তারা সকলেই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি বাঙালিদের দায়ী করে পোস্ট প্রকাশ করে।

তারা ইতি চাকমার হত্যাকন্ডের পর  হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকান্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবীতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে মিছিল, সমাবেশ, বিভিন্ন  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন,  কালো ব্যাজ ধারণসহ নানান কর্মসূচি পালন করে। যেখানে বারবার তারা বাংগালীদেরকে দোষারোপ করে। কিন্তু সকল রহস্যের উন্মোচন করে এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকায় তুষার চাকমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং আদালতে সে (তুষার চাকমা) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে যে ৫ জন চাকমা যুবক এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

ইতি চাকমার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো তারা একই কৌশল অবলম্বন করে বাংগালীদেরকে সরাসরি দোষারোপ করে। এবার দৃশ্যপটে বালাতি ত্রিপুরা নামের এক উপজাতি মহিলা। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে খুন হয় বালাতি ত্রিপুরা। এবারও আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে বিভিন্ন উপজাতি সংগঠনগুলো। শুরু হয় হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার। বালাতি ত্রিপুরা যেখানে খুন হয়েছে তার আশেপাশে বিশাল এলাকা জুড়ে কোনো বাঙালী বসতি বা বাঙালীদের যাতায়াত নেই।

তারপরও তারা সমস্ত পার্বত্য বাংগালীকে দোষারোপ না করে সুনির্দিষ্ট ভাবে করিম, নুরু আর মানিক নামে তিন বাংগালীকে দোষারোপ করে। কিন্তু বিধি বাম। এবারও তাদের কুটকৌশল ধরা পড়ে যায়। ঘটনার মাত্র ছয়দিনের মাথায় বালাতি ত্রিপুরার খুনের মূল নায়ক কার্বারী সাধন ত্রিপুরা  নামক এক উপজাতি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

১৩ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, রাংগামাটির টেক্সটাইল শো রুমের বিক্রয়কর্মী বিশাখা চাকমা কর্মস্থল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় এবং ২০ আগস্ট রাংগামাটির কাপ্তাই হ্রদে তার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পরপরই নড়েচড়ে বসে উপজাতি সংগঠনগুলো। বাংগালীদের দোষারোপ করে শুরু হয় সমাবেশ-মানববন্ধন। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় যে, বিশাখার স্বামী লক্ষীরাম চাকমার উপস্থিতিতে বখাটে সঞ্জয় চাকমা, তার সহযোগী তত্তারাম ও বিনোদ চাকমা মিলে বিশাখা চাকমাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে।

উপজাতিরা শুধু বাংগালীদেরকে দোষারোপ করেই ক্ষান্ত হয় না। সুযোগ পেলে তারা বাংগালীদেরকে হত্যা করতেও কুন্ঠিত হয় না। এমনি একটি ঘটনা ঘটে গত ৬ জুন ২০১৪ তারিখে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ব্রাক এনজিওর আনন্দ স্কুলের শিক্ষিকা উ প্রু মারমাকে ধর্ষণ করে হত্যার পর। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে স্থানীয় পাহাড়ীরা বাংগালী কাঠুরিয়া মুসলিম উদ্দিনকে ধরে গণপিটুনি দিলে তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় যে এ ঘটনায় জড়িত উপজাতি রশদ তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা।

বাংগালীদেরকে একঘরে করে রাখতে উপজাতি সংগঠণগুলো তাদের নিজ জাতিগোষ্ঠীকে নির্যাতন করতেও পিছপা হয় না। তার জ্বলন্ত উদাহরণ রাংগামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার আয়না চাকমা নামক এক কিশোরী। গত ২৯ মে ২০১৬ ইং তারিখে মা মোবাইল সেন্টার নামক এক বাঙালি ছেলের দোকানে কলেজে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে যায় আয়না চাকমা। বাংগালীর দোকানে গিয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে এই চাকমা কিশোরীকে সেখান থেকে ধরে এনে প্রকাশ্যে মারধর করে পাহাড়ের একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুধু এখানেই শেষ নয়। পরে এ কিশোরীকে গহিন জঙ্গলে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে তারা এবং এ বর্বর মুহূর্তের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে।

অনেক সময় এ ধরণের অপরাধে বাঙালীদের দায়ী করা হলেও আসল অপরাধকারী ধরা না পড়ায় ষড়যন্ত্রকারীরা তার দায়ভার বাঙালীদের উপর চাপিয়ে রেখেছে। আসল অপরাধীরা ধরা পড়লে বাঙালীরা এ অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারতো। যেমনটা ঘটেছিলো গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সবিতা চাকমার লাশ তার নিজ বাড়ির পাশের ক্ষেতে পাওয়া যাবার পর। তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন পাহাড়ী সংগঠনগুলো সবিতা চাকমা বাঙালী ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপার কর্তৃক গণধর্ষিতা হয়ে মারা গেছে বালে দাবী করে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রতিবাদ মিছিল বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

পরবর্তীতে, সবিতা চাকমার লাশের ময়না তদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন সবিতা চাকমার পিরিয়ড চলছিল এবং পিরিয়ডের অতিরিক্ত পোশাকগুলো ঠিকঠাক ছিল। পাহাড়ী একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী এই ঘটনাকে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে যে ফায়দা লুটতে চেয়েছিল বলে অনুমেয়।

সূত্র মতে, ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পরাজয়ের পরপরই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসীল ঘোষনার পর খাগড়াছড়ির তিন উপজেলায় নিজেদের প্রার্থী ঘোষনা করে তাদের বিজয়ের লক্ষ্যে স্থানীয় অধিবাসীদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়াও নানা ধরনের কুট কৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।

কোন কৌশলই যখন কাজে আসছিলো না ঠিক তখনই নির্বাচনের চার দিন আগে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি ঘাটপাড় এলাকায় উপজাতীয় নারী সবিতা চাকমাকে বাঙ্গালী ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপার কর্তৃক ধর্ষনের পর হত্যার অভিযোগ এনে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি চেষ্টা চালানো হয়। বিশেষ করে সবিতা যেখানে নিহত হয়েছে তার বহুদুর পর্যন্ত বাঙালীদের কোনো বসতি না থাকায় অভিযোগটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য করাতে না পারলেও প্রতিবাদ সমাবেশ ও প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় কিছুটা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সক্ষম হয় তারা।

সবিতা চাকমাকে বাঙ্গালী যুবক কর্তৃক ধর্ষনের পর হত্যার অভিযোগ তুলে বাঙ্গালী বিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার যে অপচেষ্টা করা হয়েছিলো সে চেষ্টার ফসল তারা ঘরে তুললেও ধীরে ধীরে আসল সত্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

একটি সুত্রে জানা গেছে, তারা এ জাতীয় অপপ্রচারের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেদের বিজয় নিশ্চিতই নয় বিভিন্ন দেশী-বিদেশী দাতা গোষ্ঠির সহমর্মিতাও আদায়ের চেষ্টাও করে। এরই অংশ হিসাবে সিএইচটি কমিশনকে দিয়ে এই ঘটনায় একটি বিবৃতিও দিয়েছিলো তারা।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, “If you want to kill the dog, give him a bad name.” অর্থাৎ যদি তুমি কোনো কুকুরকে হত্যা করতে চাও তাহলে তাকে পাগলা নামে আখ্যায়িত করো। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতীয় সংগঠনগুলো ও তাদের সশস্ত্র শাখা পার্বত্য বাঙালীদের মানুষ মনে করে না। তাই তাদের হত্যা করতে, পাহাড় থেকে বিতাড়নের অজুহাত সৃষ্টি করতে একই কায়দায় চারিত্রিক কালিমা লিপ্ত করতে অপচেষ্ট দীর্ঘদিন ধরে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব বাঙালি এবং উপজাতি এদেশেরই গর্বিত নাগরিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সকলের অবদান অপরিসীম। তাই উপজাতি-বাঙালি ভেদাভেদ আর অতীতের হানাহানি ও বিবাদ ভুলে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তবেই পার্বত্য এলাকায় শান্তির পরিবেশ আরও সুসংহত হবে এবং সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে।  অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য অঞ্চলে মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসী কর্তৃক সৃষ্ট অশান্তি সমূলে উৎপাটন করে সবাই মিলে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে পারলেই উন্নয়ন এবং উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিত হতে বাধ্য।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন