পার্বত্যাঞ্চলের সহিংস আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। চাঁদাবাজদের দুটি গ্রুপের বেপরোয়া কর্মকান্ডের বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে, অসহায়ত বোধ করছেন সাধারণ নাগরিক।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করছে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ তাদের নানান অপকর্ম দিনদিন বেড়েই চলেছে। পাহাড়ে ৩টি আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে শান্তিচুক্তির বিরোধীতাকারী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এ ব্যাপারে অন্যদের চাইতে খানিকটা বেশি বেপরোয়া। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে গত ১৮ থেকে ২২ অক্টোবরের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে এর কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়।

গত ১৮ অক্টোবর খাগড়ছড়ি জেলার পানছড়িতে চাঁদাবাজি করতে আসা ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদেরকে নিজ বাড়িতে গোপনে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় উক্ত এলাকায় বসবাসকারী প্রফুল্ল ত্রিপুরার ছেলে নিরীহ কৃষক জীবন ত্রিপুরা (৩২) কে গুলি করে গুরুতর আহত করে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। এ সময় জীবন ত্রিপুরা হাতে ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন। গুলির শব্দে পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।

অবস্থা গুরুতর দেখে আহতের নিকটাত্মীয় দেবরঞ্জন ত্রিপুরা ও ধনরঞ্জন ত্রিপুরা এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাকে প্রায় ঘন্টাখানেক পথ কাঁধে করে পাড়ি দিয়ে মরাটিলা নামক এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সিএনজি যোগে রাত ১২টায় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় গুলিবিদ্ধ জীবন ত্রিপুরাকে। কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে প্রাথমিক চিকিত্সা দিলেও তার অবস্থা গুরুতর দেখে রাত ৩টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। বর্তমানে তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন।

এদিকে ২০ অক্টোবর চাঁদাবাজির এলাকা ভাগ এবং অন্যান্য আন্তঃ দলীয় কোন্দলের জের ধরে জেএসএস (এমএন) গ্রুপের নেতা সমায়ুন চাকমাকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। খাগড়ছড়ি জেলা সদরের কমলছড়ি ভুয়াছড়ির খ্রীষ্টান পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক মো. আব্দুল হান্নান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা নিহতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নিহত সমায়ুন চাকমার মাথার ডান দিকে ধারালো অস্ত্রের কোপের দাগ রয়েছে’।

একই দিনে অন্য একটি ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় ইউপিডিএফ’র চার চাঁদাবাজকে গণধোলাই দিয়ে আটক করে স্থানীয় জনতা। পরে তাদেরকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটকৃতরা হলো খাগড়াছড়ি জেলা সদরের ভাইবোনছড়া ইউপির ছোটরায় টেইসাপাড়ার বাসিন্দা খেদারাম ত্রিপুরার ছেলে বৌদ্ধরাম ত্রিপুরা (২৯), পানছড়ি উপজেলার বৌদ্ধরামপাড়ার মবুক চাকমার ছেলে বিমল চাকমা (২৪), সুকমনি চাকমার ছেলে সুমন চাকমা (২০) এবং পানছড়ি উপজেলার দক্ষিণ নালকাটার শান্তি দুলাল চাকমার ছেলে মুকতাহার দেওয়ান চাকমা।

জানা গেছে, ইউপিডিএফ’র হয়ে তারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছিল। তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি আর অত্যাচারের কারণে সাধারণ এলাকাবাসী অতিষ্ট হয়ে এদেরকে ধরে গণধোলাই দেয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বিক্ষুদ্ধ জনতার হাত থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কাছে অস্ত্র আছে বলে স্বীকার করে। পরবর্তীতে আটককৃতদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ইউপিডিএফ’র গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আমেরিকার তৈরি ১টি পিস্তল ১টি ম্যাগজিন ও ২ রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করে নিরাপত্তা বাহিনী।

এছাড়া গতকাল রবিবার খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ’র দুই কর্মীকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। রাত আড়াইটায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল উপজেলার বড়াদম এলাকার হেডম্যান পাড়া গ্রামের রুনা চাকমার বাড়ী থেকে আটক করে তাদের। আটককৃতরা হলেন ইউপিডিএফ’র জনসংযোগ শাখার প্রধান রমেশ চাকমা (৬০)। সে বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি মুখ এলাকার মৃত মঙ্গল চন্দ্র চাকমা’র ছেলে এবং অন্যজন হলেন রমেশ চাকমার ব্যক্তিগত সহকারী অমর চাকমা (৫৮)। সে দীঘিনালা উপজেলার বৌদ্ধপাড়া গ্রামের বিভূতিভূষণ চাকমা’র ছেলে। এসময় তাদের সঙ্গে থাকা একটি ইতালির তৈরি ব্যারোটো পিস্তল এবং ছয় রাউন্ড গুলি ও তিনটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।

জানা গেছে, ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা শুধু হত্যা বা চাঁদা আদায় করেই ক্ষান্ত নেই, তারা পাহাড়ে পৈশাচিক কায়দায় নারী নির্যাতনও চালাচ্ছে। পাহাড়ি মেয়েরা বাঙালি ছেলেদের বিয়ে করলে দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করে এসব মেয়েদের ধরে নিয়ে নিজেরাই শাস্তির নামে নারীদের গণধর্ষণ করছে। সেই সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও চালায় ভয়াবহ নির্যাতন। পাহাড়ের নারী অধিকার সংগঠনগুলোকে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

এছাড়া পাহাড়ের শান্তি বিনষ্টকারী এই ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানান অপকর্মের পাশাপাশি তারা বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকে নামে-বেনামে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ বা আইডি খুলে সরকার, সেনাবাহিনী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের নিয়ে নানান মিথ্যাচার, গুজব এবং বিভ্রান্তিকর পোস্ট প্রদান করছে। তাদের এই মিথ্যাচার, গুজব এবং বিভ্রান্তিকর পোস্টের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার মত ঘটনাও ঘটছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ পরিচালিত ‘সিএইচটি জুম্মল্যান্ড’ নামক একটি ফেসবুক আইডি হতে এরূপ একটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়ানো হয়। যেখানে লেখা ছিলো- ‘(খাগড়াছড়ির) গুইমারার জালিয়াপাড়ায় পাহাড়ি-বাঙ্গালি সংঘর্ষ চলছে, সেনাবাহিনী প্রতিহত করছে, যারা গাড়িতে যাতায়াত করেন সাবধানে করবেন’। এমন গুজব প্রচারের পরদিনই উক্ত এলাকায় রবিউল নামে এক বাঙ্গালি মোটরসাইকেল চালকের লাশ পাওয়া যায়। এছাড়া গত ৩০ জুন খাগড়াছড়ির রামগড়ের সোনাইআগা নামক এলাকায় একদল ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের ঘটনাকে নিয়েও ফেসবুকে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালায় তারা। যা পরবর্তীতে পাহাড়ি-বাঙ্গালি সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনি এবং স্থানীয় প্রশাসনের তড়িত্ কর্মতত্পরতার কারণে বড় ধরনের দাঙ্গা এড়ানো সম্ভব হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন