জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর অন্ধত্ব এবং সত্য প্রকাশে অনীহা

রতন কৃষ্ণ বড়ুয়া:

পার্বত্য চট্টগ্রামের খবরগুলো আমি সবসময় একটু মনযোগ দিয়েই পড়ি দুটো কারণে- এক, আমি নিজে ওই এলাকার বাসিন্দা আর  দুই, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকাগুলোর অবস্থান এবং তাদের প্রকাশিত সংবাদ আমাকে বিনোদিত করে। ক্ষেত্র বিশেষে পত্রিকাগুলো বেশ চমকও উপহার দেয়। বর্তমান যুগে বিনোদন আর চমক পাওয়া বড়ই দুস্কর। আমাদের দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো সম্ভবত মানুষকে বিনোদন আর চমক দেবার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে।

তাই তো প্রতিদিন সকালে আমি বিনোদন আর চমক পাওয়ার লোভে প্রেসক্লাবে বসে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জাতীয় পত্রিকাগুলোর সংবাদ পড়তে ভালবাসি। আমি সংবাদ পড়ি আর হাসি। আবার কিছু কিছু পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি “বৈদ্যূতিক শক” খাওয়ার মত চমক পাই। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকি। পাতাগুলো বারবার উল্টিয়েও আমার চমক কাটে না। সে এক বড়ই আচানক অনুভূতি।

আজকের জাতীয় পত্রিকাগুলো পড়তে বসে আমি এতটাই “বৈদ্যূতিক শক” এর মত চমক পেয়েছি যে আপনাদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার কথাগুলো কি বেখাপ্পা লাগছে? তাহলে আসুন আপনাদের সাথে আজকের তাজা চমকটা একটু শেয়ার করি—

গতকাল খাগড়াছড়ি থেকে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর চট্টগ্রামে আসার কথা ছিলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সে আসছে না দেখে আমি তাকে মোবাইলে ফোন দিলাম যে পথে আবার কোন বিপদ হলো কিনা!! ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে বন্ধুর উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম-

  • হ্যালো বন্ধু, তুমি কোথায়? কতদূর এলে?
  • রতন, আজ আর আসতে পারবো না রে।
  • কেন কি হয়েছে?
  • এখানে বেশ গোলাগুলি হয়েছে। পুরা খাগড়াছড়ি শহর যেন রণক্ষেত্র। দোকান পাট সব বন্ধ। মানুষ ভয়ে আতংকিত। কেউ বের হচ্ছে না ভয়ে।
  • কিসের গোলাগুলি? কে করলো?
  • পাহাড়ি দুই দল।
  • কেন?
  • আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে মনে হচ্ছে।

কথোপকথন শেষে আমি মোবাইল রেখে কিছুটা হতাশ হয়ে বসে থাকলাম। কারণ, যে বন্ধুর আসার কথা ছিলো আমি তার কাছে বেশ কিছু টাকা পাই। টাকাগুলো আজ পরিশোধ করার কথা ছিলো। একবার ভাবলাম যে, টাকা না দেবার অযুহাতেই কি এই গোলাগুলির গল্প সাজালো নাতো? ঘটনার সত্যতা জানতে খাগড়াছড়িতে বেশ ক’জন পরিচিতজনদের কাছে মোবাইলে ফোন করলাম। সবাই ঘটনার সত্যতা জানালো। এর মাঝে বেশ কিছু অনলাইন পত্রিকা এবং টিভিতেও দেখলাম যে ঘটনা আসলেই সত্যি।

আমি কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা হতে ঘটনার যে বিবরণ জানলাম তা হুবহু তুলে ধরছিঃ

খাগড়াছড়ি সদরের স্বণির্ভর বাজারে আধিপত্য বিস্তারের জেরে পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গ্রুপের মাঝে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে বাজারের উত্তর পাশের রাবার কারখানা এলাকা ও চেঙ্গী নদীর পশ্চিম পাড় এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হঠাৎ করে রাবার কারখানা এলাকার ওই দিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। তার কিছুক্ষণ পরে নদীর পশ্চিম পাড় থেকেও গুলির শব্দ আসে। বাজারের ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিজিবির সদস্যরা এসে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। 

 

ঘটনার পর থেকে বাজারের সবক’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি-পানছড়ি আঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও পরিবহনে তল্লাশি করছে পুলিশ ও বিজিবি। ঘটনার পর খবংপুড়িয়া ও স্বর্ণিভর এলাকায় অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। খাগড়াছড়ি সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাহাদাত হোসেন টিটো বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্বণির্ভর বাজারে ইউপিডিএফ-তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে অর্ধশত রাউন্ড গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে।

দিনে দুপুরে একটা জেলা শহরের মাঝে গোলাগুলির মত এত্ত বড় একটা ঘটনা ঘটলো তাই তো সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতেই আজকের জাতীয় পত্রিকাগুলো খুলে বসেছিলাম। কিন্তু কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া বেশীরভাগ পত্রিকাতেই সংবাদটি পেলাম না। জেলা শহরের মধ্যে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে এত বড় ঘটনা ঘটলো সেটা পত্রিকায় না আসার কারণ কারণ কি হতে পারে? আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কে এর পিছনের কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করছি-

(এক)    পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বেশীরভাগ জাতীয় পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিগণ হলেন উপজাতি সম্প্রদায়ের। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা নিজস্ব জাতিগত স্বার্থরক্ষা করে চলে। সে জন্যই গতকাল পাহাড়ের দুই উপজাতি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গ্রুপের মাঝে গোলাগুলির মত এত বড় ঘটনা স্থানীয় প্রতিনিধিগণ এড়িয়ে গিয়েছেন। কারণ, তারা তাদের উপজাতি সন্ত্রাসীদের কুৎসিত রূপ দেশের মানুষের আছে উন্মোচন করতে চায় না।

(দুই)     কিছু পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিগণ অউপজাতি হলেও তারা উপজাতি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গ্রুপের অস্ত্রের মুখে জিম্মি।

(তিন)    অনেক জাতীয় গণমাধ্যম আছে যারা সন্তু লারমা, দেবাশীষ রায়সহ কতিপয় পাহাড়ি নেতাদের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডকে আড়াল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে নিয়মিতভাবে অতি উৎসাহ নিয়ে সরকার এবং নিরাপত্তাবাহিনীকে দোষারোপ করে সংবাদ প্রকাশ করে।

ঐসব গণমাধ্যমগুলো কেন এবং কোন স্বার্থে এসব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের মদদ দিচ্ছে- তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাহলে কি ধরে নিবো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলো যে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে তার একটা বড় অংশ ঐসব গণমাধ্যমগুলোর অফিসের কর্তাব্যক্তিদের পকেটে যায়?

(চার) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকারের বেশিরভাগই কোটা ও বাস্তবতার কারণে উপজাতীয় আঞ্চলিক জনপ্রতিনিধিদের দেখলে। কাজেই ঐসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধিগণ উপজাতীয় স্বার্থের বাইরে রিপোর্ট করতে পারে না।

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণমাধ্যম অফিসগুলোকে বলছি-

আপনারা সত্য প্রকাশের বিজ্ঞাপন দিলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন করছেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আপনারাই তো বলেন যে, “আমাদের চোখ বাঁধা নেই, আমাদের হাত খোলা, আমরা বলতে পারি”। কিন্তু খাগড়াছড়িতে পাহাড়ের দুই উপজাতি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গ্রুপের মাঝে গোলাগুলির মত ঘটনাকে প্রকাশ না করে আপনারা প্রমাণ করলেন যে, চোখ থাকতেও আপনারা অন্ধ, আপনাদের হাত অলৌকিক কোন মায়াজালে বাঁধা, কণ্ঠ থাকলেও আপনারা বলতে পারেন না। ধিৎকার জানাই এই হলুদ সাংবাদিকতাকে।

– লেখক: জামালখান রোড, চট্টগ্রাম থেকে

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন