চীনে মৃত মানুষ বিক্রি করে মিয়ানমারের সেনাশাসকদের ধনী হবার গল্প

হেলাল মহিউদ্দীন:

মৃত মানুষ বিক্রি করে বিলিয়নার হবার ইতিহাস একমাত্র বার্মার সেনাশাসকদেরই আছে। দীর্ঘদিনের সেনা শাসনকালে অগণিত চীনা নাগরিকের কাছে মৃত বার্মিজদের আইডি কার্ড বিক্রি করা হয়। মিয়ানমারের সেনাশাসকদের সরাসরি প্রশ্রয়ে এসব হবার নানা প্রমাণ আছে। ডোনাল্ড এম সিকিন্স এর ‘হিস্টরিক্যাল ডিকশনারি অব বার্মা’ বইতেও এসব কাণ্ডের উল্লেখ আছে।

চীনের এক সন্তান নীতির কারণে বেশি সন্তানে আগ্রহীরা মুড়ি-মুড়কির মত এই কার্ড কিনে পুরোপুরি বাধাবন্ধনমুক্ত বার্মিজ বনে যায়। কাগজে-কলমে ধরা হয় যে, বার্মার মোট জনসংখ্যার ২.৫% হান-চাইনিজ ও ৯% শান নৃ-গোষ্ঠী। কিন্তু শানদের বড় অংশ ‘কোকাং’রাও মূলত চীনা অভিবাসীই। (এখানে ৯টি প্রধান ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মিলিয়ে প্রায় ১৩৬টি নৃগোষ্ঠী আছে)। ১৯৮৪ হতে ২০০৪ পর্যন্ত অন্তত আরো ২০ লাখ চীনা অভিবাসী বার্মার স্থায়ী নাগরিকত্ব পায়। অস্থায়ী আছে বেশুমার। তাই বার্মা চীনের এক দ্রুত সম্প্রসারণশীল বাজার।

চীনা অভিবাসীসহ হান-কোকাং নৃগোষ্ঠীগুলো সেই বাজার সম্প্রসারণের যাদুর কাঠি। চীন-বার্মা প্রেমের এই সুগভীর বাণিজ্যিক আঁটুনির কাছে ‘মানবিকতা’ নস্যি হবে, এ তো জানা কথাই!

চীনসহ সম্প্রসারণবাদী কোনো রাষ্ট্রই বার্মার বাজার হাতছাড়া করার ভুল করবে না। এমনিতেই চীনের সামান্য হেলাফেলার ভুলে বার্মার ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্পটি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের হাতে চলে যায়। থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী কারেন নৃ-গোষ্ঠীর আবাসভূমিকে গ্যাস ফিল্ড বানাতে গিয়ে ১৯৮৮ হতে শুরু করে ২০০৯ পর্যন্ত কারেনদের উপরও নিবর্তন হয়। তবে তারাও বৌদ্ধ হওয়ায়, এবং সহজে থাইল্যান্ডে ও মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিতে পারায় তাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছিঁটেফোঁটাই ছিল বলা যায়।

চীনের সহায়তায় রাখাইন রাজ্য জুড়ে ৩০ লাখ একর এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করছে বার্মা। জোনটিতে চীনের কয়েকশ’ ধনকুবের অনায়াসে ও সহজ শর্তে বিনিয়োগ করছে।

বার্মায় চীনা আধিপত্য যাতে একচেটিয়া না হতে পারে সেজন্য ভারত বার্মাকে তোষামোদি করবে, উপহার-উপঢৌকন দিবে, ভর্তুকিতে বা নামমাত্র মুল্যে ভারতীয় পণ্য বেচবে; বার্মা না চাইলেও গায়ে পড়ে ‘বন্ধু বন্ধু ডাক পাড়ি’ বলে জানপ্রাণ উজাড় করে দিবে বুঝাই যায়। তাই ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল যখন বলেন— ‘চীন বাংলাদেশে অস্ত্র বেচে, চীনারাই বাংলাদেশের পক্ষে যাক; ভারতের উচিত বাংলাদেশকে নয় বার্মাকেই প্রাধান্য দেয়া’— আমাদের দিলে চোট পেয়ে লাভ নাই। ‘বন্ধুরাষ্ট্র এমনটি কীভাবে বলতে পারল’ আহাজারিতে কপাল চাপড়ানোও নিরর্থক।

চীনের সহায়তায় বার্মার নৌ-ঘাঁটির অত্যাধুনিকায়ন চলছেই। ভারত ভীতসন্ত্রস্ত। কারণ এই যজ্ঞের একটি অত্যাবশ্যক দিক হচ্ছে আরাকানের ভিতর দিয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত অত্যাধুনিক সড়ক করিডোর নির্মাণ। করিডোরটি শেষ হলে ভারতকে গিরিপথ ও সমুদ্রপথ দুই দিক দিয়েই চাপে রাখবে চীন। সারা বিশ্বে ভারতই ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। স্বভাবতই ভারত তার সুরক্ষায় ইসরায়েলের সহায়তা চাইতে ছুটছে। ইসরায়েলও এই সুযোগে এই অঞ্চলে ভারতের মাধ্যমে তার পদচ্ছাপ রাখবে। রাখাইনে যে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনটি নির্মিয়মান, তাতে মার্কিন বিনিয়োগকারী জর্জ সরোস গ্যাস উত্তোলন খাতে বিশাল বিনিয়োগ করছেন। সরোস দুই হাতে টাকা-পয়সা বিলানো ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষাকারী মিডলম্যান হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। তার বিনিয়োগের খবরে ভারতের উদ্বেগ নেই, এক ধরণের নীরব অনুমোদন ও খুশির ভাবই বরং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বলেই হয়ত সরোসের চীনেও বিনিয়োগ আছে, এবং তার সঙ্গে চীনের বেশ ভালো বোঝাপড়াও আছে।

খোদ পাকিস্তানেও জনগণ যতই ইসলামপ্রীতিই দেখাক কেন্দ্রীয় সরকার চুপটি করেই থাকবে যেহেতু চীনের আগ্রাসনে তারই লাভ। কারণ ক্ষতি হলে হবে উভয়েরই শত্রু ভারতের। তদুপরি রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ যত ঝামেলায় পড়বে পাকিস্তান ততই খুশি হবে। পাকিস্তান-বাংলাদেশের চিরশত্রুতার বয়ানটি এখন আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত বিষয়। একাত্তরের অপমান পাকিস্তানিদের অহর্নিশ তাড়িয়ে বেড়ায়।

ভারত প্রয়োজনে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেই ডাকাডাকি করবে আঞ্চলিক শান্তিরক্ষার নাম করে মিয়ানমার বা বাংলাদেশে নৌঘাঁটি স্থলঘাঁটি করতে। চীনের একচ্ছত্র আঞ্চলিক অধিপতিত্ব ঠেকানো, এবং একটি কৌশলগত লোকেশনে অবজারভেশন টাওয়ার হয়ে উঠার ভারতীয় ইচ্ছার মত হুবহু একই ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রেরও বহুদিনের। উভয়েরই, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য পুরো দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, এবং বঙ্গোপসাগরে বার্মা-বাংলাদেশ অংশগুলো এবং রাখাইন প্রদেশটিতে অনুত্তোলিত কিন্তু ভরপুর খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেয়া। তাছাড়া ফিলিপাইনে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ঘাঁটিবিরোধিতা বাড়ছে বলে সুবিক ঘাঁটির উপর নির্ভরতা কমাতেও যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প আঞ্চলিক ঘাঁটির জায়গা খুঁজছে।

ভারত যাতে বেশি যুক্তরাষ্ট্রমুখো হতে না পারে বরং রাশিয়ার সঙ্গে আদি ও পরীক্ষিত সম্পর্ক জোরদার করে এগোনোর বিকল্প ভাবনায় (আমেরিকার বদলে রাশিয়া-মিত্রতা) আস্থাশীল থাকতে পারে, সেজন্য রাশিয়াও বার্মার পক্ষ নিচ্ছে। সবার সমর্থন পেয়ে বার্মার তেজ বা বাড় এমনই বেড়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে মাস্তানি করতে, বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতেও পিছপা হচ্ছেনা। আসলে বাংলাদেশের পায়ে পাড়া দিয়ে যুদ্ধ বাঁধানোর ছুতা খুঁজছে মিয়ানমার।

উস্কানির ফাঁদে বাংলাদেশ বোকার মত পা দিয়ে বসেনি এটি স্বস্তির সংবাদ। কারণ, এই যুদ্ধোম্মত্ততায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মিয়ানমার নিজেই, বাংলাদেশ নয়। পশ্চিমা শক্তিগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক বিভাগকে দূর্নীতিগ্রস্ত করে, এবং লাই দিয়ে আসমানে তোলে অস্ত্র বিক্রির জন্য, ব্যবসা করার জন্য ও সম্পদ লুটের জন্য। তারপর সময় হলে মাটিতে আছড়ে ফেলে। নাইজেরিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, হাইতি, ফিজি, ফিলিপাইনসহ উদাহরণের কমতি নাই।

কলিন ক্যাহল তার ‘স্টেটস, স্ক্যারসিটি অ্যান্ড সিভিল স্ট্রাইফ’ বইতে উদাহরণগুলো টেনেছেন। তারও বহুদিন আগে হান্টিংটন, ফাইনারসহ অনেকেই সামরিক বাহিনীর দূর্ণীতিগ্রস্ত হওয়াকে ছকবদ্ধ প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখিয়েছেন। বার্মায় নামে গণতন্ত্র এলেও সামরিক বাহিনীই এখনো সর্বেসর্বা। সু চি’কেও  সামরিক বাহিনীর অঙ্গুলি হেলনেই চলতে হয়। সাধারণ জনগণ দীর্ঘ সামরিক শাসনে অভ্যস্ত। সামরিক শাসকরা জনগণকে উদার গণতন্ত্র বা বিশ্বমানবতার সঙ্গে পরিচিত হতে তো দেয়ইনি, বরং উগ্র জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে এসেছে। রাখাইনে বিশাল ভূখণ্ড জনমুক্ত করতে বিনিয়োগ চক্রের ক্রীড়নকগণ এবং সামরিক বাহিনী একাট্টা হয়েই নিধনযজ্ঞের ছক বানিয়েছে। তারা অশিক্ষিত জনগণকে ধর্ম ও জাতিতত্ত্ব-উন্মাদনায় উম্মত্ত করতেও শতভাগ সফল হয়েছে। এসবেরই বলি রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশের কূটনীতিকরা হয়ত ঠিকই বুঝেছেন শুধুই আবেগ আর দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধে নামা একবিংশ শতকের বাস্তবতা নয়। এই মুহুর্তে আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ সম্পূর্ণই বন্ধুহীন। যুদ্ধের ঝামেলায় পড়লে ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউই সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসবেনা। যুদ্ধ লাগলে বাংলাদেশের লোকক্ষয় ও সম্পদক্ষয়ের সীমা-পরিসীমা থাকবেনা। কিন্তু বাংলাদেশের ষোলো-সতের কোটি জনসংখ্যা, এবং একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে আমলে না নিলেও চলেনা। বার্মায় চীন-মার্কিন বিনিয়োগকারীরা অন্তত কয়েক বছর নির্বিঘ্ন মুনাফা চাইবে, যুদ্ধ চাইবেনা। যুদ্ধ নির্বিঘ্ন মুনাফা করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

এইসব কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্রীড়াণকদের লক্ষ্যই থাকবে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট এবং চাপে রাখা যাতে রোহিঙ্গাদের বা ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠীর উৎপাত বা সংগঠিত হওয়া মিয়ানমারের জন্য হুমকি না হতে পারে। বাংলাদেশ বার্মার সাম্প্রতিক উস্কানির জবাব দিলে উস্কানিদাতার মত সমান দায়েই দায়ী হত বিশ্বসমাজের চোখে। আন্তর্জাতিক কুটনীতি বলয়ে প্রভাব সৃষ্টির ক্ষমতাটিও হারাতো।

বিশ্বমোড়লদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক সমাধান বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়ন। এই বিষয়ে তারা তাই জাতিসংঘে একাট্টা থাকবে, সহায়তাও দিতে থাকবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। ইতোমধ্যে সেরকম লক্ষণও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘে সব পক্ষ এক সুরে কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগের অবস্থান বদলে রোহিঙ্গাদের দেখতে ছুটে গেছেন। আশ্রয়ের আশ্বাস, ক্যাম্পের জন্য জায়গার আশ্বাস দিয়ে এলেন। মিয়ানমার হতেই কিনছেন এক লক্ষ টন চাউল। সুবিধাজনক ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্ব মোড়লরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করতে একাট্টা হলেও হতে পারে। কূটনীতির গতি-প্রকৃতিতে ভালোমত নজর রাখলে তেমন ঘটনা ঘটতে দেখাও অসম্ভব কিছু নয়!

বাংলাদেশের চাইতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও সু চি’র বিপদে পড়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেশি। বিশ্ব মোড়লদের স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু করতে চাইলেই, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইলেই রোহিঙ্গা জেনোসাইডের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদেরকে কারাদজিক এর ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।

 

সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন