একাদশ সংসদ নির্বাচন: খাগড়াছড়িতে মামলার জালে বিএনপি, কোন্দলে আওয়ামী লীগ ও বিভক্তিতে দুর্বল ইউপিডিএফ


এইচ এম প্রফুল্ল, খাগড়াছড়ি:
জটিল সমীকরণের মধ্যেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাংগঠনিকভাবে দল গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)সহ একাধিক আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন। তবে মামলার জালে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ আছে দলীয় কোন্দলের গহ্বরে। অপরদিকে প্রসীতের ইউপিডিএফ ভেঙ্গে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গঠন হওয়ায় সংগঠনটি এখন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি(এ) ও জেএসএস(এমএন লারমা) নীরবে ভোটের মাঠ গোছাচ্ছে। তবে জামায়াতসহ অন্য ইসলামী দলগুলোর কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না খাগড়াছড়িতে। সব মিলে খাগড়াছড়ি আসনে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে।

৯টি উপজেলা ও তিন পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২৯৮ নং খাগড়াছড়ি নির্বাচনী আসনে ভোটার আছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৮ জন। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৯ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ১৪ হাজার ১৯৯ জন। তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভোটার উপজাতীয়। ভোট কেন্দ্র ১শ’ ৮১টি। তার মধ্যে দুর্গমতার কারণে নির্বাচনী কাজে দীঘিনালা ও লক্ষ্মীছড়ির ৪ কেন্দ্রে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি রাজনৈতিকভাবে ভিন্নতর। এই আসনে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ নানাভাবে আলোচিত। এই আসনের অর্ধেক ভোটার উপজাতি। এক সময় উপজাতীরা আওয়ামী লীগের আর বাঙালিরা বিএনপির ভোট ব্যাংক বলে বিবেচিত হলেও ২০০১ সাল থেকে ইউপিডিএফ উপজাতীয় ভোটে একটা বড় ভাগ বসিয়ে আসছে। একটি সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপের সক্রিয় উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে নিরাপত্তা সঙ্কটের কারণে দুর্গম এলাকার উপজাতীয় ভোটাররা ইউপিডিএফকে ভোট দিতে বাধ্য হয়। তবে সাধারণ ভোটাররা চান কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা দেওয়ার পরিবেশ।

আওয়ামী লীগ
খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সাবেক সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী এগিয়ে আছেন। তবে আরও একাধিক নেতা দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানা গেছে।
খাগড়াছড়ি আওয়ামী লীগে দু’ধারা চলছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করার অভিযোগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলমকে বহিষ্কারের প্রস্তাব করে কেন্দ্রে চিঠি পাঠায় জেলা আওয়ামী লীগ। সেই থেকে প্রতিটি কর্মসূচি পালিত হচ্ছে পৃথকভাবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি ও জাহেদুল আলমের দ্বন্দ্ব জেলা সদর থেকে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দুই পক্ষই একে অপরকে মূলস্রোত ধারা বলে দাবি করছে। প্রায় সময় দুই গ্রুপের মধ্যে পাল্টা-পাল্টি হামলা-মামলায় হাবুডুবু খাচ্ছে নেতাকর্মীরা। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার অনুসারীরা জাহেদুল আলমকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দাবি করলেও জাহেদুল আলমের দাবি তাকে বহিষ্কার করা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নির্দেশে তিনি নিষ্ক্রিয় আছেন।

জাহেদুল আলম গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে ১৬ হাজার ৫৬১ ভোট পান। পরবর্তীতে তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের বর্জনে মুখে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ৯৯ হাজার ৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তবে এবার আওয়ামী লীগের যে কোন প্রার্থীর জন্য জয় পাওয়াটা সহজ হবে না বলে মনে করেন সচেতন মহল। উপজেলা নির্বাচনে জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৮টিতে হেরেছে দলীয় প্রার্থীরা। দলীয় কোন্দলের কারণে তিন পৌরসভার দুটিই হাতছাড়া হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছাড়াও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা, পানছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল আলম দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য লবিং করছেন। দলীয় কোন্দল নিরসন না হলে নির্বাচনে জয় লাভ কঠিন হবে বলে মনে করছেন খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাই। এ জন্যে একে অন্যের উপর দায়ও চাপাচ্ছেন তারা।

জাহেদুল আলমের অভিযোগ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপির অনুসারীরা দলের ত্যাগী নেতাদের উপর হামলা ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। দলীয় কোন্দল নিরসন না হলে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিজয় কঠিন হবে। তবে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরীর দাবি খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগে কোন কোন্দল নেই। সবাই কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী দলে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সার্বক্ষণিক জেলার মানুষের সেবা ও উন্নয়নে পাশে থাকায় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছাড়া এ আসনে বিকল্প কাউকে ভাবছে না নেতাকর্মীরা।

জাহেদুল আলমের ছোট ভাই খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক দিদারুল আলম নিজেদের দলের মূলস্রোত দাবি করে বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় আমাদের দখলে আছে।

অন্যদিকে রণ বিক্রম ত্রিপুরা নিজেদের মূলস্রোত ধারার দাবি করে বলেন, যারা নির্বাচন এলে দলের প্রার্থীর বিরোধিতা করে, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে লাল কার্ড দেখায় আবার নির্বাচন গেলে নৌকায় উঠতে চায় তারা কখনো আওয়ামী লীগ হতে পারে না। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা পরিষদ সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমার মতে, যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলেই শুধু জয় সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে, অন্যথায় নয়।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মনে করে গত পাঁচ বছরে বিপুল উন্নয়নই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরসা। বিশেষ করে ‘বিদ্যুৎ সমস্যা’ নিরসন, ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি ব্রিজের বদলে স্থায়ী সেতু নির্মাণ, পিটিআই, বিনা, গুইমারা উপজেলা ও বিজিবি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং খাগড়াছড়ি হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তর, নার্স ইনস্টিটিউট, পুলিশ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ খাগড়াছড়িতে সড়ক যোগাযোগ ও ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নকে নির্বাচনের পুঁজি হিসেবে গণ্য করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, কাকে মনোনয়ন দেবেন সেটা শেখ হাসিনারই এখতিয়ার। সবই তাঁর নখদর্পণে রয়েছে। তিনি ভালোই জানেন কাকে দেবেন মনোনয়ন। শেখ হাসিনার নির্দেশে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছি। গত পাঁচ বছরে খাগড়াছড়িতে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটেছে। খাগড়াছড়ি জেলায় বিদ্যুৎ গ্রিড সাবস্টেশন চালু, সেতু ও সড়ক উন্নয়নে মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে।

সাবেক সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা আবারও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন থাকলেও তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সে ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। মারমা সম্প্রদায়ের এ নেতা মনোনয়নের জন্য লবিং-এর পাশাপাশি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া পূরণের জন্য প্রতিদিন কোন না কোন এলাকা সফরে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে কংজরী চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু দল করি, তাই দল চাইলে আমিও নির্বাচন করতে প্রস্তুত রয়েছি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবে তাঁর পক্ষেই কাজ করব।’

বিএনপি
খাগড়াছড়ি বিএনপি আটকে আছে মামলার জালে। নেতাকর্মীদের মাসের অধিকাংশ সময় ব্যয় হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। তার পরও খাগড়াছড়িতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা বেশ শক্ত। গত উপজেলা নির্বাচনে দুটি উপজেলায় বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছে। তিনটি উপজেলায় হেরেছে সামান্য ভোটের ব্যবধানে।

আগামী নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে দলের একক শক্তিশালী প্রার্থী জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তিনি দুইবারের সংসদ সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কারণে ওয়াদুদ ভূঁইয়ার অবস্থান সুদৃঢ় বলে দাবি নেতাকর্মীদের। প্রশাসনের বাধা থাকলেও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সব কর্মসূচিই পালিত হচ্ছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীতার কারণে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় সমর্থন থাকলেও সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল।

খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়, গতানুগতিকভাবে দলকে গোছানোর কাজ চলছে। সে সঙ্গে নির্বাচনের জন্যে সামগ্রিক প্রস্তুতিও রয়েছে। তিনি জানান, জরুরি সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও আগামীতে দলের মনোনয়ন নিয়ে তিনি প্রার্থী হতে তিনি প্রস্তুত।

তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য বিএনপির সকল প্রস্তুতি রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে। তবে চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে এদেশে কোন নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।

এদিকে কিছুদিন আগেও সমীরণ দেওয়ানের নেতৃত্বে পৃথকভাবে বিএনপির ব্যানারে কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ছে না। সমীরণ দেওয়ানসহ তার অনুসারীদের সকলেই এখন নিষ্ক্রিয়। সম্প্রতি জেলা বিএনপির আংশিক কমিটি ঘোষণার পর সমীরন দেওয়ানের অন্যতম সহযোগী মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র নাসির আহমেদ চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে ওয়াদুদ ভূঁইয়ার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে মূল স্রোতে ফিরেছেন। ফলে খাগড়াছড়ি বিএনপির পূর্ণ নেতৃত্ব এখন জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়ার নিয়ন্ত্রণে।

গত বছরের মার্চে কেন্দ্র ঘোষিত জেলা বিএনপির ১৫১ সদস্যের মধ্যে সভাপতি, সহসভাপতি, সম্পাদকসহ ৩১ সদস্যের নামের তালিকায় নেই সমীরণ দেওয়ান ও তার পক্ষের কারোরই। তালিকায় নাম না থাকায় অনেকটাই হতাশ তারা। এ কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে আবারও সমীরণ দেওয়ান দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানিয়েছেন তার অনুসারীরা।

জেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অনিমেষ চাকমা রিংকু বলেন, সহসাই পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসতে পারে। মোস্তাফিজুর রহমান মিল্লাতের অকাল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার পরই বৈঠকের সর্বসম্মত মতামত ও কেন্দ্রীয় পরামর্শে সাধারণ সম্পাদক পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন আমাদের নেতা ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তার বিকল্প খাগড়াছড়ি আসনে নেই।

অপর যগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু বলেন, আওয়ামী লীগের গত প্রায় সাড়ে নয় বছরের শাসনামলে জেলাব্যাপী দলের নেতাকর্মীদের নামে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মীকে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কোন কর্মসূচিই স্বাছন্দে পালন করা যাচ্ছে না। সব কর্মসূচি দলীয় কার্যালয়ের ভিতরেই করতে হয়। অনেক উপজেলায় তাও করতে দিচ্ছে না পুলিশ। কোন কোন উপজেলায় কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তা সত্ত্বেও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি দেশের যে কোন জেলার চেয়েও সুসংগঠিত।

ইউপিডিএফ
১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করে জন্ম নেয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), সাংগঠনিকভাবে তারা খাগড়াছড়িতে বেশ শক্তিশালী। সংগঠনটি ২০০১ সাল থেকে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে তাদের সাংগঠনিক শক্ত অবস্থানের জানান দিয়ে আসছে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোট পেয়েছে ইউপিডিএফ প্রার্থী। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সংগঠনের প্রধান প্রসিত বিকাশ খীসা প্রার্থী হয়ে ৬৭ হাজার ৮০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। এছাড়া জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদেও তাদের নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইউপিডিএফ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এটা অনেকটাই নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে গুইমারা উপজেলা চেয়ারম্যান উশেপ্রু মারমা ও পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা ও এডভোকেট সুমারী চাকমার নাম উচ্চরিত হচ্ছে। উশেপ্রু মারমার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হবেন বলে দাবি করেন তিনি। তবে সর্বোত্তম চাকমা হত্যাসহ একাধিক মামলা জড়িয়ে গত মে মাস থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক আলোচিত বেশ কিছু হত্যাকা-ে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃতৃন্দেও অধিকাংশের বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা রয়েছে। ফলে এসব মামলার জাল কেটে ইউপিডিএফ নেতারা নির্বাচনী মাঠে কতটুকু আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেন তার উপরও ইউপিডিএফের নির্বাচনী সাফল্য নির্ভর করছে। তবে বিগত দুই বছর ধরে ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও জেএসএসের(সন্তু) মধ্যে অবস্থানগত সমঝোতা হয়েছে। আগামী নির্বাচনেও এই সমঝোতা সক্রিয় থাকবে। তবে খাগড়াছড়ি জেলায় জেএসএসের শক্তিশালী অবস্থান না থাকায় এর প্রভাব কতোটুকু পড়বে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

এদিকে গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রসীতের ইউপিডিএফ ভেঙ্গে তপন ও তরু’র নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গঠিত হওয়ার পর এখন দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। প্রায়ই হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে তাদের মধ্যে। এতে হতাহত হচ্ছে উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা। দ্বন্দ্বের কারণে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা নিহত হওয়ার পর শ্যামল কান্তি চাকমা তরু সংগঠনের হাল ধরেছেন। ফলে ইউপিডিএফ(প্রসীত) গ্রুপের আগের সে শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষক মহল।

এ বিষয়ে ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, সরকার জেল-জুলুম দিয়ে ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনকে দমন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বর্তমানে সংস্কারবাদী ও নব্য মুখোশ বাহিনীকে দিয়ে ইউপিডিএফ নেতা, কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ লোকজনকে খুন ও অপহরণ যজ্ঞে মেতে উঠেছে। কিন্তু কোন ধরনের এবং কোন মাত্রার দমনপীড়ন চালিয়ে ইউপিডিএফ-এর আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। আগামী সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ অংশ নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মাইকেল চাকমা বলেন, পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন ইউপিডিএফ নেতারা।

জেএসএস(এমএন লারমা)
খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু) গ্রুপের তৎপরতা না থাকলেও (এমএন লারমা) অংশের সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে এ সংগঠনের সমর্থনে মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা প্রার্থী হয়ে ১০ হাজার ৬২৬ ভোট পেয়েছিলেন। তিনি এবারও প্রার্থী হতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, গত নির্বাচনে মৃণাল কান্তি ত্রিপুরাকে দলীয় প্রার্থী করা হলেও এবার কে হবেন বা দলের কী ভাবনা সেটা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সামনের নির্বাচনে যোগ্য কোনো প্রার্থী অথবা জাতীয় কোনো দলকে তাঁরা সমর্থন জানাতে পারেন বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

সদ্য গঠিত ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের পক্ষ থেকেও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, যে সব জাতীয় ও আঞ্চলিক সংগঠন এদেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করবে তাদের সাথে সমঝোতা করে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।

জাতীয় পার্টি
খাগড়াছড়িতে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা লেজেগোবরে। তাদের কোন তৎপরতা নেই বললেই চলে। মূলত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলে দলের কতিপয় নেতাকর্মীর তৎপরতা শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। তিনি গত বছর খাগড়াছড়িতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে অংশগ্রহণ করবে। এ জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। আর আওয়ামী লীগের সাথে জোটগত নির্বাচনে গেলে খাগড়াছড়ি আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টির হয়ে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান। তিনি গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৮ হাজার ১৮০ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছিলেন।

জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলম বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে তাদের প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ। আমরা তাকে নিয়েই অগ্রসর হচ্ছি।

জামায়াত
এক সময় খাগড়াছড়িতে জামাত-শিবিরের তৎপরতা থাকলেও এখন নেই। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর দমন-পীড়নের কারণে গত কয়েক বছর ধরে মাঠ ছাড়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এছাড়া ইসলামী ঐক্যজোট ও বাসদ-জাসদেরও তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই খাগড়াছড়িতে।

সব মিলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়িতে বিএনপি বনাম ইউপিডিএফের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। তবে নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অপ্রকাশ্য সমঝোতার খবর শোনা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ত্রিমুখী লড়াইয়ের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই জেলার নির্বাচনী ফলাফলের ক্ষেত্রে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে মুখোমুখী অবস্থানে থাকা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্ব নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালীন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কাও রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সেক্ষেত্রে প্রশাসন কতটুকু এই উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে উপর নির্বাচনী পরিবেশ ও ফলাফল প্রভাব বিস্তার করবে।

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বর্ষ ০১, সংখ্যা ১৬-১৭

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন