Notice: Trying to get property 'post_excerpt' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 53

Notice: Trying to get property 'guid' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 55

একজন সেটেলারের আর্তনাদ ও জিজ্ঞাসা

পারভেজ হায়দার ::

হ্যাঁ, মানুষগুলোকে ‘সেটেলার’ বলে ডাকা হয়। ‘সেটেলার’ বলে ডাক শুনতে শুনতে এক সময় তারাও ভুলে গেছে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের শেকড়।  জীবন সংগ্রামই তাদের জীবনের বাস্তবতা।  কে কি নামে ডাকলো তাতে কিছু আসে যায় না।  প্রতিনিয়ত চিন্তা, তাদের বাঁচতে হবে।  ওরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।  প্রতিনিয়ত ‘সেটেলার’ ডাক শুনতে শুনতে তারা পার্বত্য এলাকায় নিজেদের অতিরিক্ত আর পরগাছা ভাবতে শুরু করেছে।  কষ্ট যে তাদের একবারে লাগে না, তা নয়।  গরীব আর অশিক্ষিত হলেও তারা তো মানুষ, তাদেরও অনুভূতি আছে।  উপজাতি- বিশেষ করে চাকমাদের অমানবিক অত্যাচার, দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অপমান, অবহেলা, এসব সহ্য করে তাদের এই পার্বত্য এলাকায় থেকে যেতে হচ্ছে।  ওরা দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙ্গা দুঃখী মানুষ।  ত্রিশ, চল্লিশ বছর আগে সরকার তাদের এখানে নিয়ে এসেছে।  না এসে তাদের উপায়ও ছিল না।  কেউ এসেছে বরিশাল থেকে, কেউ বা আবার নেত্রকোনা থেকে, কেউ বা আবার এসেছে মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গ থেকে।  ওখানে ওদের থাকার জায়গা বা খাবার কিছুই ছিল না।  সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে তখন তাদের এখানে আসতেই হতো।  কিন্তু বেঁচে থাকার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা এখানে এসেছিল, তাতে তাদের হোঁচট খেতে হয়েছে বারবার।  সরকারের অনেক হিসেব নিকেশ নিশ্চয়ই আছে তাদের এখানে নিয়ে আসার জন্য, সেটা ওরা একেবারেই বোঝে না, শুধু জানে তারা এখানে বাঁচতে এসেছিল।

সরকার বলেছিল তাদের ৫ একর করে জমি দিবে, কিন্তু তা হয় নি।  যে জমি তাদের সরকার দেখিয়েছিল তার বেশিরভাগ জায়গায় তারা যেতেই পারেনি।  প্রতিনিয়ত চাকমাদের আক্রমণের ভয়।  এ যেন গহীন জঙ্গলে বাঘের মুখে পড়ার মতো অবস্থা।  তারপরও চলছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।  অনেকেই অবশ্য এই সংগ্রামের কষ্টে টিকতে না পেরে, তাদের আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছিল, ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করতে, এখানে চাকমাদের অত্যাচার তখন তারা মানতে পারছিল না। যাদের একেবারেই উপায় ছিল না, তারা এখানে রয়ে গিয়েছিল।

তারা চেষ্টা করলো চাকমাদের সাথে খাপ খাইয়ে চলার। এর মধ্যে অনেকের জীবন গেলো, অনেকে পঙ্গু হলো, অনেকে পুড়ে মরলো, অনেককে কাপ্তাই লেকে চুবিয়ে-ডুবিয়ে মারা হলো, কিন্তু ওদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেমে নেই। যারা চাকমাদের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে চাইলো, ওদের অনেক কিছু ছাড় দিতে হলো, ভুলে যেতে হলো তাদের আত্নসম্মান, কিছু করে খেতে চাইলে দিতে হলো চাঁদা, টাকা না দিয়ে কোন কিছু করার সুযোগ নেই এখানে, ধনী, গরীব যেমনই হোক না কেন।

শান্তিবাহিনীর উৎপাত আশির দশকে প্রকট ছিল, বাঙালিদের মধ্যে যাদের ‘সেটেলার’ বলা হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশকে তখন গুচ্চগ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শুরু হয় তাদের বস্তির জীবন।  সেখানে না আছে পড়ালেখা, না আছে কাজ। এরই মধ্যে সরকার যে জমি তাদের দিয়েছিল তার একটা বড় অংশ চাকমারা দখলে নিয়ে নিলো।  যে এক টুকরো জমি নিয়ে তারা স্বপ্ন বুনছিল, তা আর রইল না।  অনেকে অনেক কষ্ট করে পাহাড়-জঙ্গল পরিস্কার করে মূল্যবান গাছ লাগিয়েছিল, তা’ও তারা হারিয়ে ফেলল।  যারা গুচ্ছগ্রামে যায়নি, তাদের জীবন ছিলো আরো কঠিন।  প্রতিদিনই মৃত্যুর শঙ্কা।  আর্মিরা ছিলো বটে, বিভিন্নভাবে সাহায্যও করত তাদের, কিন্তু সব সময়তো আর আগলে রাখা সম্ভব না আর্মির পক্ষে। আর্মির ক্যাম্প থেকে সৈনিকরা ওদের বাঁচাতে আসতে আসতেই তাদের জীবন হারানোর আশঙ্কা ছিল।

বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ চাকমাদের খুশী রেখে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করছিল।  তাদের সাথে মিলেমিশে থাকতে গিয়ে হারাতে হয়েছিল নিজস্বতা, স্বকীয়তা, ধর্মীয় বিধি নিষেধ।  এমনও হয়েছে চাকমা শান্তিবাহিনীর নেতার কাছে নিজ ধর্মের মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, শুধুমাত্র তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য। নিজ ধর্মে নিষেধ থাকলেও ওদের সাথে তালমিলিয়ে মদ খেতে হয়েছে অনেক বাঙালির, কখনো বা নিজ দেশের আর্মির বিষয়ে খবর দিয়ে এসেছে ওদের কাছে।

দেশের সূর্য সন্তান আর্মিদের বিষয়ে খবর দিতে ওদের একবারে যে বুক কাঁপেনি তা নয়, কিন্তু ঐ যে বেঁচে থাকার আকুতি, তার বিবেককে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে রেখেছিল।

এমনি শত শত ‘সেটেলার’ বাঙালির অপ্রকাশিত গল্প রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। ওরা যেন কারো আপন নয়, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার লোকগুলো যেন চাকমাদের জন্যই মায়াকান্না বেশি। ওরা ভাবে বাংলাদেশ তো শুধু চাকমাদের দেশ নয়, ওদেরও দেশ, তাহলে ওদের প্রতি এমন অবহেলা কেন?

এখন আবার নতুন এক সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে, ওদের জমি কেড়ে নেয়া হবে, ওরা ভাবে, যে জমি সরকার তাদের দিয়েছিলো, সেই জমি আবার সরকারই কেড়ে নিয়ে চাকমাদের দিয়ে দেবে কেন?  ওদের বিস্ময়ভরা প্রশ্ন?

এমনই একজনের গল্প আজ বলব, যার কথা একেবারে অপ্রকাশিত, অনুচ্চারিত।  গল্পের প্রধান চরিত্র, পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার বাঙালির চরিত্রকে প্রতিনিধিত্ব করছে।  ওদের কেউ কেউ এসেছে বরিশাল থেকে, কেউবা আবার নোয়াখালী থেকে।  গল্পটা আমরা ও’র মুখ থেকে শুনলেও আমি ইচ্ছে করেই আঞ্চলিকতাকে বাদ দিচ্ছি।  ওদের কথায় আঞ্চলিকতা এখনো রয়ে গেছে।  ওরা শিক্ষায় বেশিদূর এগুতে পারেনি। এই চরিত্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার ‘সেটেলার’ বাঙালির চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারে মনে করে, ওর ভাষাকে আমাদের শহুরে মানুষের ভাষায় তুলে ধরছি, যাতে ওর আবেগ অনুভূতিকে নিজের মতো করে সবাই অনুভব করতে পারে।

আমি ‘সেটেলার’ মো. ইউনুস আলী (ছদ্ম নাম) রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার গুলশাখালী গ্রামে বসবাস করছি, জীবন সংগ্রামে আজ আমি নৌকার মাঝি।  আমার মনে পড়ে যায়, সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা। আমি কে? কেনই বা আজ এখানে পড়ে রয়েছি। এই প্রশ্নগুলো আমার মনে সবসময় তীব্র মানসিক পীড়া দেয়। অতীত স্মৃতি বিজড়িত জীবনের একটি মুহূর্ত শান্তিবাহিনীর সেই ভয়াল বর্বরোচিত হামলায় নিহত বাঙালি নারী পুরুষ ও শিশুদের পড়ে থাকা বিভৎস লাশ এবং আহত অবস্থায় জীবন বাঁচানোর আকুতি নিয়ে সংগ্রামরত সহযোগী ভাইদের কথা মনে পড়ে যায়, যা আমার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি না। দুঃস্বপ্নের মতো স্মৃতিগুলো বারবার আমার কাছে ফিরে আসে। কিছুতেই যেন আমি অতীত জীবনের সেই কথাগুলো ভুলতে পারি না। যাই হোক, আমার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের আগে আমার পরিচয়টা সবাইকে বলি। আমার জন্ম শেরপুর জেলার নলিতাবাড়ী উপজেলার বিজগিরি পাড়ায়। আমরা চার ভাই এবং তিন বোন, অভাবের সংসার। বাবা কৃষি কাজ করে কোনমতে চালিয়ে নিতেন। ১৯৭৯ সালের দিকে তৎকালীন সরকার দুঃস্থ, নদী ভাঙ্গা আর আমার মতো গরীব বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করে। তখন আমার বয়স ছিল প্রায় ২০ বছর, বড় সংসার, অভাব যেন পিছু ছাড়ছিলো না। এমন এক পরিস্থিতিতে ২৬ হাজার বাঙালি পরিবারের মধ্যে আমিও পুনর্বাসনের তালিকাভুক্ত হই।

তখন মনে নতুন ঠিকানায় জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। তখন অন্যান্যদের মতো আমিও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতাম। একদিন শেরপুর থেকে বাসে করে কয়েকজন বাঙালি সাথী ভাইয়ের সাথে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা করি। যাত্রাপথে নিজ জম্মভূমি, পিতা, মাতা, আত্নীয়-স্বজনকে ছেড়ে কোন মতেই যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও চলে যেতে হলো এবং এক পর্যায়ে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট রেল ষ্টেশনে পৌঁছাই।  এসময় আমার হৃদয়টা যেন ভেঙে যাচ্ছিল, নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করেও মনের স্থিরতা আনতে পারছিলাম না।  কিন্তু পিছনে ফেরার কোন রাস্তা নেই, আর বাড়ী ফিরে গিয়ে কিছু করারও ছিল না। এমতবস্থায় মনের এই বেদনা নিয়ে আমাকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হালুয়াঘাট থেকে ট্রেনযোগে চট্টগ্রামে আসতে হয়। পরবর্তীতে সেখান থেকে অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমিও চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্প এলাকায় পৌঁছাই।  শুনেছি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নদী ভাঙ্গা, দুঃস্থ আর আমার মতো গরীবদের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে আনা হয়েছে এবং এখান থেকে তিন পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হবে।

জীবন যুদ্ধে নতুন স্বপ্নের আশায় সেখানে অন্যান্য বাঙালিদের সাথে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বিনিময় করি, এসময়ে সেখানে উপস্থিত বাঙালি ভাইদের দিকে তাকিয়ে কারো চোখে আনন্দ দেখছিলাম না, সবার মধ্যেই এক ধরনের ভয় আর উৎকণ্ঠা। আমার মনে কেন যেন অজানা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম। ভাগ্যের লটারি খেলায় জীবন সংগ্রামে অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমাকে পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলায় রওনা দিতে হয়।

আমি শেরপুরের মানুষ, জীবনে পাহাড়-পর্বত, ঘনঘন বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ঘেরা পর্বতময় রাস্তা আগে দেখিনি। শুনেছিলাম, শান্তিবাহিনী পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি আর আর্মির উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অনেককে মেরে ফেলেছিল। এসময়ে এ বিষয়টি মনে পড়ে গেলে অন্যান্য বাঙালি ভাইদের মতো আমিও এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি। চট্টগ্রাম হতে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশে তাকিয়ে দেখি, চারদিকে পাহাড় আর ঘনবন ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পড়ে না। মাঝে মধ্যে আমার সাথী ভাইদের সাথে নিজ পরিবারের অতীত ইতিহাস নিয়ে কথা বলে নিজেদের দুঃখকে হালকা করার চেষ্টা করি। অজানা রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে আমাদের কারো মনে ভাল লাগছিল না।

জীবন যুদ্ধের এই খেলায় আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু সরু পাহাড়ী পথে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাসে চড়ে রাস্তা অতিক্রমকালে আমি নতুন স্বপ্নের ঠিকানা প্রাপ্তির আশায় বিভোর হয়ে পড়ছিলাম। কখন যে এই যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে মনে মনে এই প্রত্যাশায় বুক বেঁধে রাখি। বিপদ সঙ্কুল পরিবেশে কোন এক সময় অন্যান্য সাথী ভাইদের সাথে আমিও রাঙ্গামাটিতে পৌঁছাই, তখন আমার মনে কিছুটা প্রশান্তি আসে। সেখানে কিছু সময় থাকার পর অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমাকে রাঙ্গামাটি থেকে লঞ্চযোগে লংগদু উপজেলার মাইনী বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা করতে হয়। সমতলে জীবনযাপন করা মানুষ আমি দীর্ঘ পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে নদী পথে আবার যাত্রা করা আমার জন্য কিছুটা কষ্টকর হলেও নতুন বৈচিত্রময় পথ সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। রাঙ্গামাটি কাপ্তাই লেকের যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। অপরদিকে নদী পথের দৃষ্টির শেষ সীমানায় ঘন গাছপালা বেষ্টিত পাহাড় আর পাহাড়, একদিকে শান্তিবাহিনীর হামলার ভয় অপরদিকে বিপদ সঙ্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশ, উভয় ক্ষেত্রে যেন আতঙ্ক হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। এরকম পরিস্থিতিতে আমি ও আমার সাথী ভাইয়েরা জীবন রক্ষার জন্য সৃষ্টিকর্তার দয়া ছাড়া বিকল্প কিছুই ভাবতে পারছিলাম না।

রাঙ্গামাটি কাপ্তাই লেক হয়ে নদী পথে লংগদু যাওয়ার সময় পানির অব্যাহত ঢেউ যেন মনের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করছিল। এরকম প্রতিকুল পরিবেশে আমি অন্যান্য সাথী ভাইদেরকে নিয়ে ঐদিন বিকাল চারটায় মাইনী বাজারে পৌঁছাই। সেখানে লঞ্চ থেকে মাটিতে নেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হলো অজানা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মাটির সন্ধান পেয়েছি। আমার কাছে কিছু টাকা ছিল। সে টাকা দিয়ে চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রান্না করি। রাতের খাবার খেয়ে অন্যান্য বাঙালিদের মতো খোলা আকাশের নিচে মশারী টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন সকালে উঠে অন্যান্য বাঙালিদের সাথে স্থানীয় চেয়ারম্যান, হেডম্যান আর আর্মিরা মিলে বসতভিটার জন্য আধা একর এবং ফসল চাষের জন্য ২ একর জমি দখল বুঝিয়ে দেয়। এত দূর এসে সামান্য এইটুকু জমি পেয়েও খুশী মনে মেনে নিয়েছিলাম, যদিও সরকার বলেছিল বসতভিটা আর চাষাবাদের জন্য ৫ একর জমি দেয়া হবে।

জমি পেয়ে আমি অন্যান্য বাঙালিদের মতো নতুন করে বসতি গড়ে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। নিজ বাড়ীতে ফেলে আসা স্বজনদের ভুলে থাকার চেষ্টা করে নতুন ঠিকানায় বাঁচার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ি। আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করতাম, চেয়ারম্যান, হেডম্যান, আর্মি, আনসার সবার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। ওদের জন্য বিভিন্ন কাজ করে দিতাম। ওদের কাছে আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেই খবর শুনতাম। ওদের কাছেই শুনেছিলাম পার্বত্য জেলাসমূহের বিভিন্ন স্থানে ২৬ হাজার বাঙালি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। তারা সবাই পাহাড়ী এলাকায় শান্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে নতুন পরিবেশে বসবাস শুরু করেছিলো।

অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমিও ছোটখাটো একটি ঘর তৈরী করি। আর যে জমি পেয়েছিলাম সেই জমিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন শুরু করি। এর মধ্যে যা ভাবিনি তাই ঘটতে শুরু করল। শান্তিবাহিনীর লোকজন আমাদের আর্মির সহযোগী ভাবতে শুরু করলো। শুনলাম, বিভিন্ন জায়গায় ওরা বাঙালিদের কাছে পেলেই মারছে। যদি শান্তিবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও হামলার ব্যাপকতা আমি আগে আন্দাজ করতে পারতাম তাহলে হয়তোবা জীবনটাকে নিয়ে নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করতাম। কে জানে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় এভাবে অনান্য বাঙালিদের মতো আমাকেও লংগদু এলাকায় থাকতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় বাঙালিদের চাষাবাদ করতে শান্তিবাহিনীর বাধা, জোর করে ফসল কেটে নেওয়া, ফসল ও বসতভিটায় আগুন দেয়া, অপহরণ করে ধরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হল। এ বিষয়গুলো আমি আমার সাথী ভাইদের সাথে আলোচনা করতাম। আমরা কি অপরাধ করেছি? আমরা কি বাংলাদেশের নাগরিক নই? কেন নিরাপরাধ বাঙালিরা শান্তিবাহিনী আর পাহাড়ীদের বর্বরোচিত হামলার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হচ্ছে? আমরা তো নিজ ইচ্ছায় এখানে আসিনি। আমার প্রশ্ন, আমরা পুনর্বাসিত বাঙালিরা আর্মির সহযোগী এজেন্ট হিসাবে কাজ করছি- এমন ধারণাতে কেনইবা শান্তিবাহিনী পাকিস্তানী হায়েনার মতো নৃশংস ও নির্মমভাবে বাঙালি মা, বোনদের ওপর অত্যাচারের পাশাপাশি বিভৎসভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠবে? সে সময়ে অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমিও নিরস্ত্র। ক্ষেতে খামারে কাজ করার সময় অথবা পাহাড়ের ঢালুতে কাজ করার সময় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা বাঙালিদের উপর হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যেত।

অতীতের এমন বহু ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, অথবা অন্যান্যদের মাধ্যমে আমি জেনেছি। কিভাবে রাতের বেলায় ঘুমন্ত বাঙালি পরিবারের উপর কাপুরুষের মতো বর্বরভাবে শান্তিবাহিনী গুলি করে নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেছে। শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল অথবা বাঙালি ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছিল, এরকম স্পর্শকাতর সময়েও শান্তিবাহিনী পাখির মত বাঙালি ভাই, বোন ও শিশুদের শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বসতভিটায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এমন অনেক ঘটনা আজ ইতিহাসের পরিক্রমায় চাপা পড়ে আছে। এক প্রতিবেশীর কাছে শুনেছিলাম, ১৯৭৯ সালে শান্তিবাহিনী লংগদুর কয়েকটি বাঙালি পাড়ায় প্রবেশ করে ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যার পর ১০৪টি বাঙালি বসতভিটা আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করেছিলো।  একই বছর আমাদের পাশের এলাকায় সাত বাঙালিকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এদের মধ্যে এরশাদ নামের এক বাঙালিকে মাথায় গুলি করে। একই ঘটনায় অন্য তিন জন পুরুষ, দুই জন মহিলা এবং এক জন শিশুও প্রাণ হারায়।  শুধু কি তাই, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চে ২৯ জন এবং ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ৬ জন বাঙালিকে শান্তিবাহিনীর লোকেরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে যে নির্মমভাবে হত্যা করে তা সভ্য জগতের যেকোন সম্প্রদায়ের বিবেককে নাড়া না দিয়ে পারে না।

বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে শান্তিবাহিনী নির্বিচারে ব্যাপকহারে পার্বত্য জেলাগুলোতে ভয়াবহভাবে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠে। আমি মনের স্মৃতি ভাণ্ডারে সঞ্চিত বিভৎসময় ঘটনা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের বিবেকের কাছে মানবতার দাবী নিয়ে জানাতে চাই- আমরা কি রাষ্ট্রীয় নাগরিক অধিকার ভোগ করার দাবিদার নই? যারা নির্মমভাবে বাঙালি জাতির একটি অংশকে শুধুমাত্র নিষ্পেষিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এবং অসংখ্য বাঙালি হত্যার দায়ে তাদের আইনের কাঠগড়ায় আনা হয়নি কেন- এটি আমার জাতির কাছে জিজ্ঞাসা।

শান্তিবাহিনীর হামলায় নিহত, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি পরিবার ও আর্মির সৈনিক ভাইদের ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস নিজের চোখের সামনে ভেসে উঠলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মনে হয় মৃত্যুকূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে হায়েনার আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা আমি, সাথী ভাইদের হারানোর বেদনা আমাকে আজীবন তাদের হত্যার বিচারের জন্য আহবান জানাবে। কিন্তু এই আমি কি তাদের সেই প্রত্যাশা কখনো পূরণ করতে পারবো?

পার্বত্য এলাকায় শান্তিবাহিনীর ভয়াল আক্রমণে হারিয়ে যাওয়া ভাইদের স্মৃতিচারণ করতে গেলে আমি দু’চোখের পানি আটকে ধরে রাখতে পারি না, তার পরেও কয়েকটি ঘটনার কথা বলতে চাই।

১৯৮৪ সালের ৩১ মে রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার ভুষণছড়ায় শান্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৩৮৪ জন বাঙালি নিহত হয়েছিল এবং ২৬৪টি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় শান্তিবাহিনীর ও পাহাড়ীদের আক্রমণে আরো অনেক বাঙালি নিহত হয়।  ১৯৮৬ সালের ৪ জুন লংগদু উপজেলার রাজনগর গ্রামে হামলা চালিলে ১১ জন বাঙালিকে হত্যা ও দুই শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, ২ জুলাই দীঘিনালায় ২৪ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা এবং ৩২ জনকে অপহরণ, একই বছর ১৯ জুলাই খাগড়াছড়িতে আর্মির উপর হামলা চালিয়ে এক সৈনিক ভাইকে হত্যা এবং ৭ জনকে আহত করা, ৭ আগস্ট ২ জন আনসার সিপাহীকে অপহরণ করে হত্যা করা, ১৯৮৭ সালের ২১ জুন দীঘিনালার নারাইছড়িতে আর্মির আব্দুর রাজ্জাক, ইসমাইল হোসেন ও মোহন লালকে গুলি করে হত্যা করা, একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়ায় ২২ জন কাঠুরিয়াকে গুম করা, ১৯৮৯ সালের ২ নভেম্বর বাঘাইছড়ির শীলছড়িতে দুইজন আর্মি সৈনিককে গুলি করে হত্যা করা ও একই বছর ২৭ জানুয়ারি বন বিভাগের কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বজল আহমেদ এবং মাহবুবুল আলমকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা, একই বছর শান্তিবাহিনীর এবং পাহাড়ীদের আক্রমণে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১২০০ বাঙালি নিহত হয়। শান্তিবাহিনীর বাঙালি নিধনের ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। তারা ১৯৯২ সালের ২৯ জুন মহালছড়ি-রাঙামাটির সড়কে সেনাবাহিনীর চেক পোস্টে আক্রমণ করে দুই জন আর্মি সৈনিককে গুলি করে হত্যা, একই বছর ১০ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলায় খিরাম বন বিভাগ কার্যলয়ে হামলা চালিয়ে ৬ কর্মচারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শান্তিবাহিনীর বাঙালি নিধন পর্ব এভাবে অব্যাহত থাকায় সে সময়ে আমি এবং আমার সঙ্গী কতিপয় বাঙালি ভাইদের মৃত্যুকুপ এই পাহাড়ে জীবন শেষ হয়ে যাবে ভেবে সব সময় মনের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করত। আর্মি ভাইদের এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও তারা সব সময় আমাদের পাশে ছিল, তারা সব সময় আমাদের মনে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু তারা তো আর সব সয়য় আমাদের পাহারা দিয়ে রাখতে পারতো না।

আমরা নিরস্ত্র বাঙালিরা কিভাবে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকবো এসব নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম। এর মধ্যে একটা ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল। ১৯৯৬ সালে ৯ সেপ্টেম্বর পাকুয়াখালীতে তারা ৩৫ জন বাঙালি কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ২৮ জন বাঙালির লাশ উদ্ধার করে লংগদু থানা সদরে দাফন করা হয়, অবশিষ্টদের আজও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি।

এই রকম অসংখ্য ঘটনা এখানকার স্বল্পশিক্ষিত/অশিক্ষিত বাঙালিরা বুকে ধারণ করে আছে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলেও বিভিন্নস্থানে পাহাড়ী সন্ত্রাসী বাহিনী আর পাহাড়ীদের অত্যাচার থেমে থাকেনি। ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল বাঘাইহাটে বাংগালীদের ১৮১টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পরের বছর ২০০৯ সালের ৬ মে বাঘাইহাট গঙ্গারামে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা আমাদের বাঙালি ভাই আলকাস, আমান, মজিব ও রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২০১১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লংগদুতে বাঙালি পাড়ায় ৪০টিরও বেশি বাঙালি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

একটি স্বাধীন দেশে যেকোন নাগরিকের দেশের যেকোন জেলায় বসবাসের অধিকার থাকার কথা। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এদেশের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম। সরকারের ইচ্ছায় আমাদেরকে এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে, কেন আমরা শান্তিবাহিনী, উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনের বলির পাঠা হয়ে জীবন হারাবো? কেন আমাদেরকে ‘সেটেলার’ বাঙালি বলা হয়? দেশের অন্যান্যস্থানের বাঙালিদের মতো আমরা যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছি, আমরাতো একই দেশের নাগরিক, কোন ভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে এসে আমাদেরকে পুনর্বাসন করা হয় নি। জাতির কাছে আমার প্রশ্ন, এতগুলো প্রাণহানির ঘটনায় যারা জড়িত তারা আজ রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে এ অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করে? এখনও আগের ধারাবাহিকতায় বাঙালীদের হত্যাসহ নানাভাবে নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে, তার কি কোন সুরাহা নেই? একই দেশের দুই ধরণের ব্যবস্থাপনা কেন? আমরা কি মানুষ নই।

শান্তিচুক্তির পর আমরা মনে করেছিলাম, হয়তো আমাদের জীবনে শান্তি ফিরে এলো। কিন্তু শান্তি কোথায়? সন্তু বাহিনীর দল অস্ত্র নিয়ে আবার ফিরে এসেছে। আবার ইউপিডিএফও অস্ত্র নিয়ে আমাদের কাছে আসে। তখন থেকে চাঁদা দেই দুই দলকেই। খুশী রাখতে হতো দুই দলকেই। এর আরো পরে ২০০৮ এর পর সন্তুর দল থেকে আরো একটা দল তৈরী হল। ওদের কাছেও অস্ত্র। ওরাও ভয় দেখায়। এখন আমরা তিন দলকেই চাঁদা দেই, তিন দলকেই ভয় পাই। এই তিন দল আবার একটা বিষয়ে একমত। ওরা কেউই বাঙালি মুসলমান সহ্য করতে পারে না। ওরা নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করলেও, আমাদের বিষয়ে ওরা সবাই এক একাট্টা। দীর্ঘ পথ ও সময় পাড়ি দিয়ে আজ আমি জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। কিন্তু উপজাতি সন্ত্রাসীদের বর্তমান কর্মকাণ্ড আমাকে সেই শান্তিবাহিনীর ভয়াল আক্রমণ ও বাঙালি নিধনের বর্বরোচিত দৃশ্যপটকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। শান্তিচুক্তির পরও আমরা একেবারে নিরাপদ নই। আর্মি এখানে আছে, এটা ঠিক। কিন্তু আমরা ওদের সাথে সমঝোতা করেই বসবাস করছি, তা না হলে অবধারিত মৃত্যু।

উপজাতি মেয়েরা বাঙালি যুবকদের বিয়ে করার জন্য পছন্দ করে। উপজাতিদের নিয়ম অনুযায়ী ওরা বাবা অথবা স্বামী, কারও নিকট থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। উপজাতি মেয়েরা অনেকটা পণ্যের মতো। তাই অনেক ক্ষেত্রে তারা বাঙালি ছেলেদের সাথে প্রেম ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। উপজাতি মেয়েরা বাঙালি যুবকদের বিয়ে করে।  এটিও উপজাতি সংগঠনগুলোর সহ্য না। তারা কোন উপজাতি মেয়েকে বাঙালি ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে, অথবা প্রেম করতে দেখলে বা বিয়ে করার চেষ্টা করলে ঐ মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার করে। আবার বিয়ে হয়ে গেলে তালাক দিতে বাধ্য করে।  আবার অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে এবং ছেলের পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে জরিমানা আদায় করে।

এভাবে অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় বসবাস করে শত প্রতিকুলতার মধ্যে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছি।  জানি না আর কত বছর আমি ও আমার অন্যান্য বাঙালি ভাইদের ভবিষ্যত বংশধর রাষ্ট্রীয় নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে উপজাতি সন্ত্রাসীদের নির্যাতন ও নিপীড়নের দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হবো। ইদানিং শুনতে পাচ্ছি, সরকার আমাদের যে জমি দিয়েছিল, তা’ থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিবে। ঐ জমি নাকি আর আমাদের থাকবে না। এই বিষয়ে আমি বলতে চাই, আমাদের যখন পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন হেডম্যান, কারবারীদের সাথে নিয়ে সরকার খাস জায়গা বলে আমাদের দেখিয়ে বন্দোবস্তি দিয়েছিল। বর্তমানে শুনছি যে, এই জায়গা চাকমাদের বন্দোবস্তি জায়গা। ১৯৭৯ সালে সরকার আমাদের জায়গা দিয়েছে আর এখন চলছে ২০১৭ সাল, এতো বছর পরে এই কথা কেন উঠল? এর আগে তারা কোথায় ছিল? সরকার খাস জায়গা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিল। তখন তাদের সাথে সেনাবাহিনী আর চাকমাদের চেয়ারম্যান এসেছিল। তারা বলেছিল, এই জায়গার উপর তোমরা ঘর তৈরী করে থাকো এসব জায়গা সরকার তোমাদের বন্দোবস্তি দিয়েছে। ঐ বন্দোবস্তি কবুলিয়াত করে আমরা আজ পর্যন্ত এই জমির উপর আছি। আমি এই জমির উপর তরুণ অবস্থ‌ায় এসেছিলাম আর এখন বড় হয়েছি এখানে, এখানেই আমি বিয়ে করেছি। বিভিন্ন ফলফলাদির যেমন বাগান করেছি, তেমন আমি সন্তানেরও বাগান করেছি। আমার দুই ছেলে আর দুই মেয়ে এই জায়গায় জম্মগ্রহণ করেছে, তাদের বিয়েও করিয়েছি এই জায়গার উপর। এখন যদি সরকার বলে এই জায়গা তোমরা ছেড়ে চলে যাও চাকমাদের দেবো, তবে আমার দেহে যতোক্ষণ এক বিন্দু তাজা রক্ত থাকবে যত বড় শক্তিশালী হাতই আসুক না কেন আমি এই জমি ছেড়ে যাব না।  শুধু আমিই না এমন হাজার হাজার বাঙালি অস্ত্রের সামনে বাঁশ নিয়ে মোকাবেলা করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছে।  সরকার বা চাকমারা যা ভাবুক এই চিন্তা-ভাবনাটা আরও অনেক আগে করার দরকার ছিলো। আমরা এই জায়গা সহজে ছাড়বো না, দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকতে।

ইউনুস এই পর্যায়ে অনেকটা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ল।  তার কাছে জমি কেড়ে নেবার চেষ্টা মানে তার অস্তিত্ব কেড়ে নেয়া। তার চোখের তীব্র ক্ষোভ আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।  তার অনেক বয়স হয়েছে। অনুভব করতে পারছি, তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে।  তার কষ্টকর আর সংগ্রামী স্মৃতি বিজড়িত জীবনের এই শেষ প্রান্তে তার চোখ ছলছল করে উঠছে, বুক ফাঁটা চাপা আর্তনাদ অনুচ্চারিত রয়ে যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন