ইসলামের পথে ফ্র্যাঙ্কির দীর্ঘযাত্রা

ফ্রাঙ্কি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ফ্র্যাঙ্কি, একজন আমেরিকান নারী। তিনি ছিলেন একজন ক্যাথলিক। পরে তার স্বামীর কারণে হয়েছিলেন মর্মন। কিন্তু তার অনুসন্ধানী মন সবসময় খুঁজে ফিরেছে প্রকৃত সত্যকে। তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন সত্যকে উদঘাটন করতে।

অবশেষে তার এই চেষ্টার কল্যাণে দেখা পান প্রকৃত সত্যের। সত্যের পথে তার সেই অনুসন্ধানী দীর্ঘযাত্রার আদ্যপ্রান্ত নিয়ে লিখেছেন অনইসলাম ডটকমে।

‘আমি একজন আমেরিকান নারী। পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন যে ধর্ম রয়েছে, তার অধিকাংশ সর্ম্পকে জানতে এবং বিশ্বাস স্থাপন করতে চেষ্টা করেছি। আমি ছিলাম একজন ক্যাথলিক, পরে একজন মেথডিস্ট এবং অতিসম্প্রতি একজন মর্মন।

আমি বহু বছর ধরেই প্রকৃত সত্যকে খুঁজে পেতে অনুসন্ধান করেছি। আমার এই অনুসন্ধানে, আমি নবীদের কিছু শিক্ষা এবং কিছু অর্ধমিশ্রিত সত্যের দেখা পাই। আমার স্বামীর অনুরোধে আমি মর্মন চার্চে যোগদান করি। আমি বিশ্বাসের সাথেই কিছু দিন সেখানে যেতে চেষ্টা করি। আমার নিজের আধ্যাত্মিক বিষয় সর্ম্পকে জানার আগ্রহের কারণে সেখানকার কিছু মানুষ আমার সাথে অত্যন্ত অসম্মানজনক আচরণ করতে থাকে।

আমার ভাবনা ছিল তারা যা বিশ্বাস করে একটু কঠোরভাবে চেষ্টা করলে আমিও তা বিশ্বাস করতে পারব কিন্তু তারা যা কিছু শিক্ষা দেবে তার সবগুলোই অন্ধবিশ্বাসে গ্রহণ করব না। আমি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথেই প্রতি রবিবার গির্জায় গিয়ে সামনের সারিতে বসতাম। গির্জার ধর্মীয় সঙ্গীতে নেতৃত্ব দিতাম এবং কিছু ক্লাসে শিশুদের শেখাতে সাহায্য করতাম।

যতটা সম্ভব আমি কঠোরতার সাথে সেগুলো বুঝার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি বাস্তবিকভাবেই তা বুঝতে পারিনি। ভাবতাম ওরা যা অনুভব করতে পারে আমি কেন তা পারি না। একসময় আমি গির্জায় যাওয়া বন্ধ করে দেই এবং যতটা সম্ভব এই লোকদের এড়িয়ে চলতে থাকি।

আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন যে বিষয়টি ছিল তা হল আমার স্বামী। তিনি খুবই বিশ্বস্ত একজন মর্মন এবং আমার গির্জায় যাওয়া বন্ধ করাকে তিনি পছন্দ করতেন না।

আমি বাইবেল পাঠ করেছি এবং দেখলাম ধর্মকে বোঝার জন্য এটি একটি চমৎকার উৎস হতে পারে কিন্তু সবসময় আমার কাছে অনুভূত হত এখনেও কোনো কিছু অনুপস্থিত রয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি ইন্টারনেটের কল্যানে অনলাইনে যুক্ত হই এবং এর মাধ্যমে আমি আহমদ নামে এক লোকের সাক্ষাৎ পাই। আমি তার সাথে কথা বলার পর তার সর্ম্পকে খুবই আগ্রহী হই। কারণ তিনি ছিলেন বেশ ভারসাম্যপূর্ণ এবং আত্মবিশ্বাসী।

আমি অবশ্যই আপনাদের বলব অনলাইনে সাধারণত আমি যা করি। অজানা ভয়ের কারণেই আমি সাধারণত অনলাইনে রাজনীতি ও ধর্ম এই দুটি বিষয় নিয়ে আপত্তিকর কোনো কিছু আলোচনা করি না।

আমি আহমদের বক্তব্য শুনতে থাকি এবং তার এ বক্তব্য আমার অন্তরে আশ্চর্য এক অনুভূতির জন্ম দেয়। আমি তার কথায় উষ্ণ ও সুন্দর কিছু অনুভব করতে পারি। তার বিশ্বাসে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি এবং ভাবতে থাকি কেমন করে সে এতটা আত্মবিশ্বাসী, এতটা যৌক্তিক।

আমি তার কথায় অত্যন্ত মুগ্ধ হতাম। তিনি গাজা থেকে আমার সাথে কথা বলতে। আমি এর পূর্বে এত দূরের কারো সাথে কখনও অনলাইনে কথা বলিনি। তিনি এত মজার লোক ছিলেন যে অনলাইন বসলেই আমার সাথে কথা বলতেন। তিনি তখন আমাকে বললেন যে, তিনি একজন মুসলিম এবং তার বিশ্বাসের কিছু বাণী আমাকে ব্যাখ্যা করে শুনালেন।

আমি স্বীকার করছি যে, শুরুতে আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা ভাবতে বা বিবেচনা করতেও ভয় পেতাম। যদিও আমি আমার ধর্মের অনেক কিছুরই অর্থ বুঝতে পারতাম না এবং একসময় অনুভব করতে থাকি, আমার এ সর্ম্পকে আরো অধিক জানা প্রয়োজন।

আমরা অনলাইনে অব্যাহতভাবে বেশ কিছু সময় কথা চালিয়ে যাই। তার সাথে কথা বলে আমি ইসলাম সর্ম্পকে আগ্রহী হই। ইসলাম সর্ম্পকে জানার জন্য আহমদ প্রতিদিন আমাকে এই সর্ম্পকিত অনেক প্রবন্ধ পাঠাতেন। এমনকি এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।

আমার যখন বাল্য বয়স তখন আমি একবারের জন্য মুসলিম শব্দটি শুনেছিলাম এবং তখন সত্যিই জানতাম না যে এটি বাস্তবে বিদ্যমান আছে।

আহমদ আমাকে ইসলাম সর্ম্পকিত যে প্রবন্ধগুলো পাঠিয়ে ছিলেন দুই দিনেই আমি সেগুলো পড়ে শেষ করি। লেখাগুলো পড়ে আমি এই বিষয়গুলোর সাথে এত বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পরি যে, রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না।

আমি সবসময় তাকে এই বিষয়ে আরো অনেক অনেক লেখা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করি। কারণ সবকিছু আমার জানা প্রয়োজন। মনে হত আমি এটি সর্ম্পকে যথেষ্ট লেখা পাইনি। আমি সবসময় ইন্টারনেটে অন্যান্য মুসলিমদের অনুসন্ধান করতে থাকি যাতে আমি এ সর্ম্পকে আরও বেশি জানতে পারি।

প্রথম প্রথম মনে হতো হয়তো আর কোনো জায়গা নেই, যেখানে আমি আরো অধিক তথ্য পেতে পারি। ২ দিন চেষ্টার পর, মুসলিম গ্রুপের সাথে কথা বলার একটি চ্যাট রুমের সন্ধান পাই। পরে আমি গ্রুপটির কাছ থেকে একটি চিঠি পাই, যেখানে তারা আমাকে তাদের চ্যাট রুমের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে।

প্রথম যখন আমি চ্যাট রুমে প্রবেশ করার পর আমার ভিতর প্রবল লজ্জাবোধ কাজ করে। এ কারণে আমি তাদের কিছু বলতে চাইনি। আমি শুধুমাত্র বসে তাদের আলোচনা দেখতে চেয়েছি। যাইহোক, আমার এই লজ্জাবোধ খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। তাদের সাথে যুক্ত হওয়া মাত্রই অনলাইনে উপস্থিত থাকা সব নারী ও পুরুষ আমাকে শুভেচ্ছা জানায়। সেখানে আমি তাদের এতো ভালবাসা পাই যা আমার মনকে তা দারুণভাবে উৎফুল্ল করে।

তারা তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে তাদের বোন বলে সম্বোধন করল এবং আমাকে অনেককিছু জিজ্ঞাসা করল। প্রথমে আমার মধ্য একটু জড়তা ছিল কিন্তু আমার এই জড়তাও খুব দ্রুতই কেটে যায়। তাদের অমায়িক ব্যবহারে মুহূর্তেই আমি যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দবোধ করি এবং তাদের প্রশ্ন করতে শুরু করি।

ফরিদ নামে একজন ব্যক্তি আমাকে স্বাগত জানালেন, যাকে আমরা সবাই আঙ্কেল বলে ডাকি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তার কাছে বিশেষ কোনো কিছু জানতে চাই কিনা। আমি নারীদের পোশাক সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং প্রথমেই তার কাছে এই সর্ম্পকে জানতে চাইলাম।

আমি তাকে বললাম, আমি বুঝতে পারি না কেন মুসলিম নারীরা তাদের শরীরকে এতটা পর্দার মধ্যে ঢেকে রাখে। তিনি খুবই ভদ্র একজন লোক এবং বিষয়টি আমাকে স্ববিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি আমাকে জানালেন, এর প্রধান কারণ হল একজন নারীর তার স্বামী ছাড়া অন্য কোনো লোককে তার শরীর প্রদর্শন করা অশোভন এবং অন্যায়।

আমরা কয়েক মিনিট কথা বললাম এবং তারপর আরো অন্যান্য কয়েকজন সদস্য এতে যোগ দেয়। তারাও আমাকে তাদের বোন হিসেবে শুভেচ্ছা জানায়। ইসলামের প্রতি আমার অনুভূতি দেখে তারা সবাই আমার প্রতি খুব আগ্রহী ছিল, বিশেষ করে স্টেসি ও এহসান নামে একজন নারী ও একজন পুরুষ।

স্টেসি এবং এহসান অনলাইনে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী আমার সাথে কথা কথা বলেন এবং আমি যে সম্পর্কে জানতে চেয়েছি তা আমাকে জানান। এরপর আমি আর স্টেসি দুজনে মিলে কথা বলতে থাকি। স্টেসি আমাকে জানান যে, তিনি ৩ বছর পূর্বে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।

আমরা আরো বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে কথা বললাম যেগুলো আমি শিখতে চিয়েছি। স্টেসির সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে তার প্রতি আমার বেশি গভীর ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা জন্মায় এবং আমিও তাদের একজন হতে চাইলাম।

আমি তাকে বললাম যে, আমি এই মুহূর্তে ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। আমার এই সিদ্ধান্তে তিনি অত্যন্ত গর্বিত বলে স্টেসি আমাকে জানান এবং আমাকে কালেমা পাঠ করানোর জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি একজনকে ফোন দিলেন।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্টেসি এবং এহসানের সঙ্গে আমি ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করি। স্টেসি ম্যাসাচুসেটস থেকে এবং এহসান যুক্তরাজ্য থেকে আমাকে ফোন করেন।

আমরা প্রায় ৩ ঘণ্টার মত ফোনে কথা বলি। আমি অনুভব করতে পারি, এই মানুষগুলো যা বলেছে তার প্রতি তারা কতটা বিশ্বাসী ও কতটা আবেগপ্রবণ। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও আবেগ আমাকে উদ্বেলিত করে এবং এরপর আমিও তাদের এই বিশ্বাসের একটি অংশ হতে চাইলাম। আমি তাদের বললাম যে, আমি কালেমা গ্রহন করতে চাই এবং এহসান ফোনের মাধ্যমে আমাকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিলেন।

কালেমা পাঠ করার পূর্বে আমার হাত অব্যাহতভাবে কাঁপতে থাকে এবং আমার অন্তরে এক অন্যরকম ঝড় বয়ে যায়। আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম।

আরবিতে কালেমা পাঠ শেষ করার পর আমার হাতের কাঁপুনি থেমে যায় এবং পরিশেষে আমার মাঝে পরম শান্তি অনুভূত হয়। আমি আনন্দে কাঁদতে শুরু করি। পূর্বে আমার জীবনে কখনও এমন অনুভূতি জন্মায়নি এবং আমি অনেক আনন্দিত হলাম।

এখন আমি একজন ‘মুসলিম বোন’। আমার বর্তমান দিনগুলোতে আমি অনেক সুখী। আমি জানি, আমি অবশেষে সত্যকে খুঁজে পেয়েছি।

আমার পুরানো বন্ধুদের অনেকের সাথে আমার তেমন কোনো কথা হয় না। কারণ তারা আমাকে বলে আমি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে ভুল করেছি।

তবে আমি যা শিখেছি তা আমার কাছে সেরা আর তা হল মুসলিম হওয়া কেবলমাত্র একটি শব্দ নয়, এটি একটি কর্মপ্রক্রিয়া, একটি সত্যিকার জীবন পদ্ধতি।

পরিশেষে আমি যা পেয়েছি তা নিয়ে আমি অনেক ভালো আছি এবং কারো ভয়ে কিংবা কোনো কিছুর বিনিময়ে কখনও এতে পরিবর্তন আসবে না। আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি, আমাকে অবশেষে তার সত্যের পথে পরিচালিত করার জন্য।

সূত্র: আরটি্এনএন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন