ইউপিডিএফের দেড়যুগ পূর্তির প্রাক্কালে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী জানালেন প্রসীত-শঙ্কর
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:
পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়া যুগের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির দেড় যুগ পূর্তিতে সকল কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী তথা সর্বস্তরের জনগণের প্রতি সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিবাদন জানিয়েছে। সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রত্যাখান করে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসীত খীসার নেতৃত্বে সংগঠনের জম্ম হয়।
রবিবার ইউপিডিএফ-এর সভাপতি প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সকল নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘ইউপিডিএফের এতদূর আসার পেছনে রয়েছে আড়াই শতাধিক নেতা, কর্মী ও সমর্থকের আত্মবলিদান এবং আরো শত শত নেতা কর্মী ও সমর্থকের জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ, ত্যাগ তিতিক্ষা, অমানুষিক পরিশ্রম ও কঠোর সংগ্রাম।’
এক যুক্ত বিবৃতিতে দুই নেতা বলেন, ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর গঠনের পর থেকে ইউপিডিএফ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সকল ধরনের অন্যায় অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই সংগ্রামে বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, সব সময় জনগণের পাশে থেকেছে এবং তাদের চরম দুর্দিনে ও দুঃসময়ে আশার আলো দেখিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল বিরোধী গণ সংগ্রাম, যৌন সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সংবিধানে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতির উপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরোপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউপিডিএফের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করে ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় বলেন, ‘আধুনিক মতাদর্শে সুসজ্জিত একটি আদর্শিক ও সুশৃঙ্খল পার্টি ছাড়া বর্তমান দুনিয়ায় কোন আন্দোলনে জয়যুক্ত হওয়া যায় না; অপরদিকে এ ধরনের পার্টি ও জনগণ এক মন এক প্রাণ হয়ে সংগ্রাম করলেই কেবল অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।’
প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদিতা ও দালালির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং জনগণের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের বৃহত্তর সংগ্রাম এক ও অভিন্ন মন্তব্য করে তারা বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও দালালদের মুখোশ উন্মোচন ও তাদের পরাস্ত না করে জনগণের কোন আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পারে না। এ জন্য যারা আন্দোলনের নামে বিভ্রান্তি ও বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের হীন ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য তারা জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি। অপারেশন উত্তরণের নামে চলা অঘোষিত সেনা শাসনে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। গণতান্ত্রিক অধিকার আজ বুটের তলায় পিষ্ট এবং অন্যায় ধরপাকড়, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, তল্লাশির নামে হয়রানি, হুমকি, ভূমি বেদখল, নারীর উপর যৌন সন্ত্রাস নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এই অবিচার ও দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য কঠোর সংগ্রাম ছাড়া জনগণের সামনে আর অন্য কোন পথ খোলা নেই বলে তারা মন্তব্য করেন।
সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমি কমিশনের মূলো ঝুলিয়ে রেখে জনগণকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করছে মন্তব্য করে ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় আরো বলেন, যে সরকার গত দীর্ঘ ১৯ বছরে চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি, ভূমি কমিশনের অগণতান্ত্রিক ধারা সংশোধন করতে ১৫ বছর কাল ক্ষেপণ করেছে, সে সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস স্থাপন করা জনগণের জন্য আত্মহননের সামিল।
তারা সরকারের মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রেখে ও সুবিধাবাদী, দালাল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচারণায় কর্ণপাত না করে চলমান হৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের সংগ্রামসহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই জোরদার করার আহ্বান জানান।
তারা বলেন, ভূমি পুনরুদ্ধারের আইনী লড়াইকে একটি উচ্চতর রাজনৈতিক সংগ্রামে উন্নীত করতে হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা হলো মূলত একটি রাজনৈতিক সমস্যা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন সংগ্রাম দেশের আপামর জনগণের শোষণ-বৈষম্যমুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন নয় উল্লেখ করে বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, দেশের শাসক শোষক গোষ্ঠী এক জাতির বিরুদ্ধে অন্য জাতির জনগণকে এবং এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে তথা কৃত্রিম জাতিগত ও সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে ও সেটা জিইয়ে রেখে নিজেদের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তারা বলেন, দেশে শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেই কেবল বাঙালি জাতির পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগুলো তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি নিয়ে সুষ্ঠুভাবে মুক্ত পরিবেশে নিজেদের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হতে পারে।
কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমাসহ ইউপিডিএফের বেশ কয়েক জন নেতাকর্মীকে এখনো জেলে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে শত শত নেতা-কর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে।
সকল বাধা বিপত্তি মোকাবিলা করে ভূমি বেদখল বিরোধী আন্দোলনসহ বহু লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ইউপিডিএফ বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। বিবৃতিতে দাবী করা হয়,পার্বত্য চুক্তির পর এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর থেকে এই পার্টির ওপর বহু দমন পীড়ন চলে আসছে।