আরসার সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কী?

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমারের রাখাইনে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ চলমান থাকা অবস্থায় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিতের কথা জানিয়ে একতরফা অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

তবে আগস্টে রাখাইনে সেনাঅভিযান শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে অমুসলিমদের প্রতি তাদের বিদ্বেষের খবর প্রকাশিত হয়। দলীয় সদস্য হতে চাপ দেওয়া, ধর্মান্তরে বাধ্য করা, বাড়িঘরে আগুন দেওয়াসহ বহু মানুষকে হত্যার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ৮৬ হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। সবশেষ সোমবার রাখাইনে এক ‘হিন্দু গণকবর’র সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এর জন্য আরসাকে দায়ী করে।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে সেই দায় অস্বীকার করা হলেও আরসার কর্মকাণ্ডকে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, আরসা মিয়ানমার সরকারের ভূমিকাকেই বৈধতা জুগিয়ে যাচ্ছে।
রাখাইন কমিশনের শীর্ষ ব্যক্তি সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের মিয়ানমার সফরের মধ্যেই ২৫ আগস্ট ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যকে হত্যার দায় শিকার করে আরসা।

এর একদিন পরেই হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসে আরসা’র প্রধান নেতা আতাউল্লাহ জুনুনির মুখপাত্র আবদুল্লাহর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। কফি আনানের সফরের মধ্যেই কেন এমন হামলা— এ প্রশ্নের উত্তরে ওই সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ বলেন, ‘আঘাতের জবাব দিতেই আরসা ওই সময় হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মরক্ষার আর কোনও বিকল্প ছিল না।’

তবে ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাচারি আবুজা মনে করেন, সেনাবাহিনীকে বড় ধরনের পাল্টা আঘাতকে উদ্বুদ্ধ করতেই আরসা হামলা চালিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আরসার হামলা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল একটি কঠোর জবাবকে উসকে দিয়ে আন্তর্জাতিক মনযোগ আকর্ষণ করা ও সহানুভূতি আদায় করা। এ মনযোগ ও সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সদস্য ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে চেয়েছিল তারা।’

চ্যানেল নিউজ এশিয়া দাবি করছে, অধ্যাপক আবুজার একটি প্রতিবেদন তাদের হাতে এসেছে, যেটি এখনও প্রকাশ পায়নি। ওই প্রতিবেদনে আবুজা লিখেছেন, ‘‘আরসা ভালোভাবেই জানত, সামরিক বাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ ও ‘মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনে’র মধ্য দিয়ে বদলা নেবে। সরকারের দমনমূলক নীতির কারণে অনেকে আরসা’র সঙ্গে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ হবে। এটা হলো জঙ্গিদের নিজেদের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা।’’ বাস্তবেও তাই হয়েছিল। আরসার হামলার পরই সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন জোরদার হয়েছিল।

কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসির মিয়ানমার বিশ্লেষক রিচার্ড হোরসি বলেন, ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সংকট তৈরির জন্য দায়ী কোনও সংগঠন যদি বলে তারা তা জনগণের সুরক্ষার স্বার্থে করছে, তবে তা ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নেওয়াটা কঠিন।’

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারে ৮৬ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যার খবর জানা যায়। এশিয়ান এইজ-এ প্রকাশিত ওই সময়ের এক প্রতিবেদনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কালু শীল নামের এক ব্যক্তি স্বীকার করেন, মিয়ানমারে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই মুসলমান। তবে হিন্দু রোহিঙ্গাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি আরসা ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী— দু’পক্ষকেই দায়ী করেন। কালু শীল বলেন, ‘বার্মার সেনাবাহিনী আর আরসা আমাদের গ্রামজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। শত শত মানুষকে গলা কেটে অথবা ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে। বেঁচে থাকা মানুষদের তাড়িয়ে দিতে বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে অন্য শরণার্থীদের কাছেও

আগস্টের হামলায় তিন শিশুসহ ছয় জনকে হত্যার প্রত্যক্ষ অভিযোগ রয়েছে আরসার বিরুদ্ধে। সেই সময়ে তাদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ হাজির করেছিল দ্য অস্ট্রেলিয়ান। ওই প্রতিবেদনে আরসার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা নূর আলী বলেন, ‘সেনাবাহিনীর হাতে এমন অস্ত্র আছে যা দিয়ে দুই মাইল দূরে হামলা করা যায়। আরসার কী আছে?’

মিয়ানমারের সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে থাইল্যান্ডে চলে যাওয়া এক সাংবাদিকের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অলাভজনক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। মিয়ানমার প্রশ্নে এই সংবাদমাধ্যমের অবস্থান স্বাধীন বলে মনে করা হয়। চলতি মাসের ৮ তারিখে ইরাবতীর এক প্রতিবেদনেও আরসার প্রতি রোহিঙ্গাদের অনাস্থার প্রসঙ্গ উঠে আসে।

মংডু শহরের বাসিন্দারা ইরাওয়ার্দিকে জানায়, সেখানে সিউ জার নামের এক গ্রামে ১৩ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস। এদের অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হলেও সেখানে বৌদ্ধ আর হিন্দুরাও রয়েছেন। এদের মুসলিম ধর্ম গ্রহণের জন্য চাপ দেয় আরসা। পাশাপাশি তাদের দলে যোগ দিতেও চাপ দেওয়া হয়। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, আরসার জঙ্গি কার্যক্রমে সমর্থন নেই গ্রামবাসীর। তবে রোষানলে পড়ার ভয়েই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না।

২৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইমরান রাখাইনের সহিংসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। চ্যানেল নিউ এশিয়াকে তিনি বলেন, ‘আরসার সঙ্গে যোগ দেওয়াটা আত্মহত্যার সামিল।’ জুলাইয়ে মিয়ানমার ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়া আরেক রোহিঙ্গা ইমরান বলেন, ‘আমি তাদের (আরসা) সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী নই। কিন্তু কোনও কোনও তরুণ তা করছে। কারণ মিয়ানমার সরকারকে নিয়ে তারা হতাশ।’

এএফপির খবরে বলা হয়েছে, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৩০ হাজার মানুষও সহিংসতা কবলতি রাখাইন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এএফপিকে জানিয়েছে, আরসার জঙ্গিরাই তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। আর সোমবার গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এক শরণার্থীর বরাত দিয়ে মিয়ানমার সরকার দাবি করছে, আরসার প্রায় তিনশ জঙ্গি তাদের গ্রামে ঢুকেছিল। তারা একশ জন হিন্দু ও বৌদ্ধকে ধরে গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সারিবদ্ধভাবে রাখা ছবি প্রকাশ করা হলেও কোনও সংবাদমাধ্যমের পক্ষেই ছবিগুলো স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়নি।

ইয়েবাওকিয়া গ্রামে যেখানে মরদেহগুলো পাওয়া গেছে, সেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্পদ্রায়ের মানুষের বসবাস। সেই এলাকার নাম খামংসেখ। গত সপ্তাহে এই এলাকার হিন্দুরাই এএফপিকে বলেছিল, আরসা সদস্যরা ২৫ আগস্ট লাঠি ও ছুরি নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং সবার ওপর আক্রমণ করতে থাকে। হিন্দু নারীদেরও অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছিল সেসময়।

ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে আরসা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া একটি অডিওবার্তায় ওই মুখপাত্র দাবি করেন, বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করতে চাইছে। এজন্য তারা আরসা সদস্যদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।

আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জঙ্গিগোষ্ঠীর ব্যাপারে জানাশোনা রয়েছে এমন এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা সূত্রকে উদ্ধৃত করে চ্যানেল নিউজ এশিয়া জানায়, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে আরসা বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। সংগঠনটি তাদের উদ্দেশ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।’ কয়েকদিন আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘নিগৃহীত রোহিঙ্গাদের মুক্তির কথা বলা হলেও আরসার কর্মকাণ্ডে আদতে লাভ হয়েছে মিয়ানমার রাষ্ট্রের। এখন সব রোহিঙ্গা পুরুষকেই সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করার অজুহাত পেয়েছে সরকার। তারা এই অজুহাতকে নির্বিচারি অভিযানের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে হাজির করছে।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন